পৃথিবীর বুকে যেন একটুকরা জান্নাত

পৃথিবীর বুকে যেন একটুকরা জান্নাত
পৃথিবীর বুকে যেন একটুকরা জান্নাত

পরিমহল। স্থাপত্যশৈলী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এক সম্মিলনের নাম। ভূস্বর্গ কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি পরিমহল। উর্দু পরিমহলের বাংলা অর্থ পরিদের বাসস্থান।

জাবারওয়ান পর্বত চূড়ায় অবস্থিত ঐতিহাসিক এই স্থাপনা ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থিত। পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, পরিপাটি বাগান ও ইতিহাসের মায়াবী ছায়া সহজেই দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ডাল লেক। অল্প দূরেই রয়েছে মোগল উদ্যান চাশমে শাহি।

পরিমহল কাশ্মীরের মোগল স্থাপত্যগুলোর অন্যতম, বরং এটা মোগল যুগের ইসলামী স্থাপত্যশৈলী, কারুকাজ ও নকশার আকর্ষণীয় উদাহরণ। খিলানযুক্ত দরজা, স্তরবিশিষ্ট বাগান, জটিল পানির প্রবাহ ও ঝরনা পরিমহলের সৌন্দর্যের প্রধান প্রধান দিক। এর স্থাপত্যরীতিতে ইসলামী ও পারস্যের স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ দেখা যায়। এতে রয়েছে ইসলামী স্থাপত্যরীতির জ্যামিতিক এবং পারসিক শৈলীর জটিল ও সূক্ষ্ম কারুকাজ।

সোপানযুক্ত বাগান পরিমহলের অনন্য বৈশিষ্ট্য। মহলের চার দিকের সোপানযুক্ত বাগানকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল ফুলগাছ দিয়ে। বসন্তের আগমনে বাগানগুলোতে যখন ফুল ফোটে, মনে হয় যেন রূপে মেখম মেলে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিচ্ছে পরিমহল।
মোগল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহজাদা দারা শিকো ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে পরিমহল নির্মাণ করেন। শাহজাদা দারা শিকো ১৬৪০, ১৬৪৫ ও ১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে এখানে বসবাস করেছিলেন।

পরিমহল একটি মানমন্দির হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষবিদ্যার চর্চাও হয়েছে। দারা শিকো তাঁর সুফি শিক্ষক মোল্লাহ শাহকে পরিমহল উৎসর্গ করেন। এখানে সুফিবাদের চর্চা হতো। দারা শিকো পরিমহলকে একই সঙ্গে জ্ঞানকেন্দ্র ও আবাসিক ভবন হিসেবে গড়ে তোলেন। এখানে তিনি একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও গড়ে তোলেন।
পরিমহলের নামকরণ নিয়ে স্থানীয়দের ভেতরে নানা উপাখ্যান প্রচলিত আছে। একটি জনপ্রিয় উপাখ্যান হলো, এখানে রাজকন্যাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দি রাখা হয়েছিল। রাজকন্যাদের বশীভূত করা হয়েছিল কালো জাদু দিয়ে। আবার কারো কারো বিশ্বাস, এখানে সত্যিই পরিদের আনাগোনা আছে। জোত্স্না রাতে এখানে পরিরা ঘুরে বেড়ায়। দিনের আলোয় আত্মগোপন করে থাকে তারা। কাশ্মীরের মায়েরা পরম যত্নে সন্তানদের পরিমহলের পরিদের গল্প শোনায় এবং শিশুরা সেখানে পরির সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় ছোটাছুটি করে। আবার কারো মতে, স্ত্রী নাদিরা বেগমের নামেই দারা শিকো পরিমহলের নাম দেন। কেননা তিনি নাদিরা বেগমকে পরি সম্বোধন করতেন।

ঐতিহাসিক সামির হামদানি লেখেন, পরিমহলের স্থান নির্বাচন, নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সব কিছুতে মোল্লাহ শাহ বাদাকশি (রহ.)-এর ভূমিকা ছিল। তিনি মূল আধুনিক আফগানিস্তানের বাদাকশান অঞ্চলের একজন সুফি সাধক ছিলেন। শাহজাদা দারা শিকো ও শাহজাদি জাহানারা বেগমের আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। কাশ্মীরে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক স্থাপনা নির্মাণে তাঁরা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। তাঁরা তিনজন মিলে কাশ্মীরে মোগল উদ্যানগুলো ও মসজিদ নির্মাণে একটি অবকাঠামোগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। লাহোরে অবস্থিত নাদিরা বেগমের সমাধিসৌধ, শ্রীনগরের আখুন মোল্লাহ শাহ মসজিদ এবং পরিমহল উদ্যান প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

কাশ্মীরে অবস্থিত অন্যান্য মোগল উদ্যানের মতো পরিমহলে কোনো প্রাকৃতিক ঝরনা বা জলপ্রপাত নেই। এখানকার ঝরনাগুলো কৃত্রিম এবং তা নির্ধারিত জলাধারের সঙ্গে যুক্ত। ভূগর্ভস্থ পোড়ামাটির নল দিয়ে পানি সরবরাহ করা হতো। তবে তুষারপাতের মতো প্রাকৃতিক কারণগুলো এর জলধারায় গতি সৃষ্টি করে।

পরিমহলের সোপান বা স্তর মোট ছয়টি। যার সামষ্টিক বিস্তৃতি ৪০০ ফুট। প্রতিটি স্তর ১৭৯ থেকে ২০৫ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত। ওপরের সোপান দুটির একটি লেকের দিকে এবং অপরটি পাহাড়ে নির্মিত কৃত্রিম ঝরনার দিকে ফেরানো। তবে তৃতীয় সোপানটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে একটি হাম্মাম রয়েছে। এই অংশের কারুকাজও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।

পরিমহলে দাঁড়ালে ডাল লেক, শ্রীনগর শহর ও আশপাশের পুরো দৃশ্য দেখা যায়। রাতের আলোকসজ্জায় পরিমহলকেও দূর থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই আকর্ষণীয় মনে হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সংরক্ষণে ভারত সরকারের অবহেলা রয়েছে।

তথ্যঋণ : কাশ্মীর লাইফ ডটনেট ও কান্ট্রিসাইড কাশ্মীর