বাংলা ভাষা সংক্রান্ত; ২য় পর্ব

বাংলা ভাষা সংক্রান্ত; ২য় পর্ব
বাংলা ভাষা সংক্রান্ত; ২য় পর্ব

ইংরেজ হ্যালহেডের মতে বাংলা গদ্যের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা লিখিত ভাষা প্রয়োজনমত সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডার আহরণ করত বলেই নাকি ভাষার রীতি অকৃত্রিম ও সরল ছিল। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের গদ্যের উৎপত্তি ও বিকাশ অধ্যায়ে বাংলা ভাষার সংস্কৃতীকরণের শুরুতে বলা হয়েছে যে ঐ সময়ের ( ১৭৫৭ পরবর্তী দশক সমূহে ১৭৭৮ – ১৭৯৩ ) দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায় প্রচলিত তদ্ভব , আরবি-ফার্সি ও দেশজ শব্দ মিশ্রিত ভাষা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের প্রভাবে সংস্কৃত শব্দ বহুল হয়ে ওঠে এবং গদ্যরীতির মধ্যে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের উদ্ভব হয় ।

১. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কেন্দ্রিক সাহিত্যিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে বাংলা গদ্যকে সংস্কৃতঘেঁষা করণ ও বাংলা গদ্যের রূপ ও প্রকৃতির পরিবর্তন ( বিকৃতি সাধন ) ।
২. তখনকার দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায় প্রচলিত বাংলা ছিল তদ্ভব , আরবী – ফারসী ও দেশজ শব্দ মিশ্রিত যা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মাধ্যমে অপ্রচলিত সংস্কৃত ( তৎসম ) শব্দ বহুল ভাষায় রূপান্তরিত হয় এবং এ ভাবেই ভাষায় এক ধরণের কৃত্রিম ভাবগাম্ভীর্যেরও উদ্ভব হয় যা সংস্কৃতঘেঁষা কৃত্রিম এই পণ্ডিতী ভাষাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত জনগণের কাছে অনেক দুর্বোধ্য ও অবোধগম্য করে তোলার জন্য দায়ী।
৩. ইংরেজ হ্যালহেডের মতে বাংলা গদ্যের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা লিখিত ভাষা প্রয়োজনমত সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডার আহরণ করত বলেই নাকি ভাষার রীতি অকৃত্রিম ও সরল ছিল। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের গদ্যের উৎপত্তি ও বিকাশ অধ্যায়ে বাংলা ভাষার সংস্কৃতীকরণের শুরুতে বলা হয়েছে যে ঐ সময়ের ( ১৭৫৭ পরবর্তী দশক সমূহে ১৭৭৮ – ১৭৯৩ ) দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায় প্রচলিত তদ্ভব , আরবি-ফার্সি ও দেশজ শব্দ মিশ্রিত ভাষা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের প্রভাবে সংস্কৃত শব্দ বহুল হয়ে ওঠে এবং গদ্যরীতির মধ্যে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের উদ্ভব হয় । আর হ্যালহেডের অভিমতের ঠিক বিপরীতে সংস্কৃত শব্দ বাহুল্য জনিত এই কৃত্রিম গাম্ভীর্যই ভাষার সারল্য নষ্ট করে তা সাধারণ জনগণের কাছে জটিল ও দুর্বোধ্য করে তোলে । বরং ঐ সময়ের প্রচলিত তদ্ভব , আরবি-ফার্সি ও দেশজ শব্দ মিশ্রিত কথ্য ভাষাই সরল , অকৃত্রিম ও আপামর সাধারণ জনগণের কাছে সহজবোধ্য ও বোধগম্য ছিল ।
৪. ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড এবং পরবর্তীতে হেনরি পিটস ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরি – এ তিন ইংল্যান্ডীয় পণ্ডিত বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান বলে অভিহিত করে এ ভাষায় আরবী – ফারসী অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি ও প্রচার করতে থাকেন এবং ১৭৭৮ সালে আরবী – ফারসী নিসূদন যজ্ঞের সূত্রপাত হয়। আর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কেন্দ্রিক এই তিন ইংল্যান্ডীয় পণ্ডিত সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের উদ্যোগ , যত্ন ও চেষ্টায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ( মাত্র ২২ বছর ) আরবী ফারসী শব্দ উচ্ছেদ করে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ঘেঁষা ও সংস্কৃত শব্দ বাহুল্যের ভাষায় রূপান্তরিত করেন । আর সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেই বাংলা ভাষার এই বিরাট রূপান্তর ও আমূল পরিবর্তন প্রক্রিয়া সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ , তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়িত হয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যটা ছিল ইসলাম, পবিত্র কুরআন , মহানবী (সা) হাদীস ও সীরাত ( জীবন চরিত ) ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবন ধারা ( লাইফ স্টাইল) এবং আরবী – ফারসী ভাষার সাথে বঙ্গদেশের জনগণের দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর অধিককালের সম্পর্ককে ছিন্ন করা । তাই বাংলা ভাষার এ বিরাট আমূল পরিবর্তন ও বিকৃতির জন্য সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রশাসন ও সরকারই মূলতঃ দায়ী । ( আর জঘন্য সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য , উদ্দেশ্য ও স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে অথবা বলপূর্বক এ ধরনের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও বিকৃতি ইংরেজ( ব্রিটিশ) ও অন্য সকল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে। )
৫. ১৮৩৮ সালে আইনের ( অবৈধ দখলদার সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের আইনও অবৈধ ) সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কোম্পানি প্রশাসনের সদর মফস্বল আদালত সমূহে আরবী – ফারসীর পরিবর্তে বাংলা ( সংস্কৃতঘেঁষা সংস্কৃত শব্দ বাহুল্যের বাংলা যা বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে ছিল জটিল , দুর্বোধ্য ও অবোধগম্য) ও ইংরেজি ( তা ছিল জনগণের কাছে দুর্বোধ্য ও অবোধগম্য তা ) প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৭৭৮ সালে শুরু করা আরবী ফারসী নিসূদন যজ্ঞের পূর্ণাহুতি ঘটে । বাংলা ও ইংরেজির প্রবর্তন নয় আসলে নামকে ওয়াস্তে বাংলা এবং প্রধানত: ও কার্যত: ইংরেজি ভাষার ই প্রবর্তন করে অত্যন্ত সুকৌশলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ!! আর বাংলাদেশের অফিস – আদালতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখনও ইংরেজি ভাষার দৌরাত্ম , চল ও ব্যবহার বহাল তবিয়তে বলবৎ আছে। তাই এখনও নিশ্চিত হয় নি সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার । …… সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও মানছে না কেউ ( দ্র : ekushey – tv , 17-2-2022 )। আর সবাই মানবেই বা কিভাবে? কারণ যে উচ্চ আদালত এই ফরমান জারি করেছেন সেই আদালত নিজেই নিজ জারিকৃত ফরমান লংঘন করছেন ইংরেজিতে বিচারের রায় দান অব্যাহত রেখে । যুগান্তরের ( ২১-২-২০২২) এ খবর ও প্রতিবেদন লক্ষ্য করুন : আর উচ্চ আদালতেও উপেক্ষিত আছে বাংলা ভাষার ব্যবহার । কয়েক জন বিচারপতি ( ক্বাযী) ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলায় কিছু রায় দিলেও তা খুবই কম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ইংরেজি না জানা বিচার প্রার্থীরা প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন [ তাহলে ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজ শাসনামলে আদালত ( ১৮৩৮ সাল ) থেকে আরবী – ফারসী উঠিয়ে ইংরেজি প্রবর্তন করা হলে ঐ সময়ের বাংলার আপামর জনগণ যে কেমন ও কত বিরাট বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয় অথচ এখন বহু লোক সেই সময়ের চাইতেও অনেক বেশি ও ভালো ইংরেজি জেনেও ইংরেজিতে রায় দেওয়ার কারণে জনগণ দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন !!! ]।
এ যেন সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াতে গিয়ে সর্ষের মধ্যেই ভূত বসে থাকার ই নামান্তর ! তার মানে কথা হচ্ছে যে,১৮৩৮ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ কোম্পানি সরকার আইন করে তাদের সদর মফস্বল আদালত সমূহে আরবী – ফারসী ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাংলা ও ইংরেজির যুগপৎ প্রবর্তন করে নি । আসলে তখন বাংলার প্রবর্তন করাই হয় নি বরং সুচতুর ব্রিটিশরা করেছিল ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রচলন যা আজও অব্যাহত আছে এবং একুশে টিভি ও যুগান্তর সংবাদ পত্রের এ বছরের ( ২০২২ ) ফেব্রুয়ারি মাসের খবর ও প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়টির ভালো প্রমাণও মেলে।
৬. ইংরেজরাই বাংলা ভাষায় আরবী – ফারসী পদকে অশুদ্ধ এবং সংস্কৃত ( তদ্ভব ) পদকে শুদ্ধ বলে প্রচার করে যা এখনও দু:খজনক ভাবে অব্যাহত আছে। সুযোগ সুবিধা পেলেই ইংরেজরা আরবী – ফারসীর বিরোধিতা করত এবং বাংলা (সংস্কৃতঘেঁষা ও সংস্কৃত শব্দ বাহুল্যপূর্ণ বাংলা ) ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিত ।অবোধগম্য , দুর্বোধ্য , অপ্রচলিত কঠিন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার ইংরেজ প্রবর্তিত রীতিনীতির কারণে আধুনিকতা , অসাম্প্রদায়িকতা , প্রগতিশীলতা , উন্নত মননশীলতা ও মানসিকতা , রুচিবোধ , বিদ্যা – বুদ্ধি , বৈজ্ঞানিকতা , শুদ্ধ মার্জিত ভাষা জ্ঞান , ভদ্রতা ও সভ্যতার প্রতীক বলে আজও গণ্য হচ্ছে । আর ভাষায় আরবী – ফারসী পদের ব্যবহার এখনও প্রতিক্রিয়া শীতলতা , গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, সেকেলে পনা , খ্যাত ও মান্ধাতার আমলের হওয়া , অনুন্নত মন – মানসিকতা , মুর্খতা – অজ্ঞতা , অশুদ্ধ রীতি , অভদ্রতা ও অসভ্যতা বলেই গণ্য হচ্ছে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষিত ও সুশীল সমাজের কাছে এবং সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে । সংস্কৃত তৎসম শব্দকে নিজস্ব , একান্ত আপন ও পরিচিত এবং আরবী – ফারসী শব্দকে পর ও অপরিচিত বলেই গণ্য করা হয় । এ অবস্থা আসলে ইংরেজদের সৃষ্ট যা আজও অব্যাহত আছে। ইংরেজদের প্রভাবের বরকতে (!) আরবী ফারসী শব্দ প্রয়োগ ও ব্যবহার করলেই তা পশ্চাদপদ অনগ্রসর সাম্প্রদায়িক মুসলমানী বাংলা বলে গণ্য করা হয় যদিও বাঙ্গালী জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। আর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করলে তা আর সাম্প্রদায়িক হিন্দুয়ানী বাংলা বলে গণ্য হয় না যদিও হিন্দুরা বাঙ্গালী জাতির সংখ্যালঘু অংশ । এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা ও অধিকার সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় । আর ধরে নেওয়া হয় যে বঙ্গ ভাষাভাষী হিন্দু মুসলমান সবাই সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য মেনে নিয়েছে । কিন্তু সবাই আসলে স্বতস্ফুর্ত ভাবে এ প্রাধান্য কবুল করে নি ও মেনে নেয় নি । বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন কর্তৃক সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত , অবহেলিত দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও চরম বৈষম্যের শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী মুসলমানদের ওপর জোর করেই সংস্কৃত বাহুল্য ও প্রাধান্যের ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল এই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যাতে করে আরবী – ফারসী ভাষা , পবিত্র কুরআন ও ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে বাঙ্গালী মুসলমানদের সম্পর্ক ছিন্ন বা অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে যায় এবং ইংরেজ প্রবর্তিত সাম্রাজ্যবাদী বস্তুবাদী ভাব – ধারায় ও সংস্কৃতিতে যেন তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । অসহায় বাঙ্গালী মুসলমানরা এর বিরোধিতা করে একশো বছরের অধিক কাল ( ১৭৬০ – ১৮৬০ এবং তৎপরবর্তী বছর গুলোয় এমনকি বিংশ শতকের প্রথম দিকেও ) ধরে এবং তারা পুঁথি সাহিত্যের ভাষা যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আগে প্রচলিত তদ্ভব , আরবি-ফার্সি ও দেশজ শব্দ মিশ্রিত বাংলা সদৃশ তা আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং ব্যবহার করতেন এবং এ ভাষা রীতি ও পুঁথি সাহিত্য বাংলার আপামর জনগণ বিশেষ করে গ্রামীণ মুসলমান সমাজে জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। পুঁথি সাহিত্য প্রসঙ্গে ড: মুহম্মদ এনামুল হক লিখেছেন: ইংরেজ আমলের গোড়া হইতে রাজনৈতিক কারণে মুসলমানেরা বিমাতাসুলভ ব্যবহার পাইতে থাকে এবং হিন্দুরা ইংরেজদের হাতে প্রাধান্য লাভ করে। ফলে , নিম্নবঙ্গের সাধারণ মুসলমানেরা তাহাদের বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের প্রতিবাদ স্বরূপ ফারসি ও উর্দু ভারাক্রান্ত করিয়া এক স্বতন্ত্র ভাষার সৃষ্টি করিতে থাকেন । এই ভাষা ওহাবী বা ফরায়েযী আন্দোলন হইতে শক্তি সঞ্চয় করে এবং এক বিরাট ধর্মীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস পায়। কলিকাতার বটতলার কল্যাণে হাওড়া, হুগলী ও চব্বিশ পরগণার মুসলমানেরা এই সাহিত্য মুদ্রিত করিয়া দেশে ছড়াইতে ভাল ব্যবসায় ফাঁদিয়া বসে । …. ইহাতে সাহিত্য আছে , রস আছে , শিল্পও আছে তবে, তাহার বেশির ভাগই মোগলাই। ( দ্র: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কবিওয়ালা ও শায়ের , পৃ : ৩৫৩ )
এই পুঁথি সাহিত্যের বাংলায় ছিল আরবী – ফারসী শব্দের প্রাচুর্য্যপূর্ণ ব্যবহার এবং তা ছিল সাধারণ মানুষেরও বোধগম্য । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে : সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা এবং আকর্ষণীয় আবেগ এই দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিশেষ সময়ে এর ব্যপক প্রসার ঘটে । এতে উদ্বুগ্ধ হয়ে পুঁথি সাহিত্যের ধারায় অনেক কবিই কাব্য রচনায় আত্ম নিয়োগ করেছিলেন । ” সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে আরবী – ফারসী শব্দের প্রাচুর্য্যপূর্ণ বাংলা বা পুঁথি সাহিত্যের বাংলাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য ভাষা তবে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত সংস্কৃতঘেঁষা ও সংস্কৃত শব্দ বাহুল্যের বাংলা নয় । কিন্তু সব ধরনের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ১০০ বছরের অধিক কাল টিকে থাকার সংগ্রাম করে এ আরবী ফারসী শব্দের প্রাচুর্য্যপূর্ণ বাংলা এবং বঙ্গের সাধারণ জনগণ । কিন্তু অবশেষে তারা এ সংগ্রামে পরাজিত হয় এবং আরবী ফারসী শব্দের প্রাচুর্য্যপূর্ণ বাংলা সবদিক থেকে নির্বাসিত হয় । আসলে যে কোন ভাষা ও সাহিত্য – সংস্কৃতির প্রসারে রাষ্ট্র বা রাজ শক্তি যথেষ্ট ও যুগান্তরকরী প্রভাব রাখে। ভাষা যে তার আপন গতিতে ও স্বাভাবিক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়
তা সব সময় সঠিক নয় । বরং রাজশক্তি বা রাষ্ট্রের প্রভাব বা হস্তক্ষেপে ভাষার দ্রুত পরিবর্তন এমনকি বিকৃতি ও বিলুপ্তিও হতে পারে!
সংস্কৃতঘেঁষা ও সংস্কৃত শব্দ বাহুল্যের বাংলা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রভাব , আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যের অভাবে তদ্ভব , আরবি-ফার্সি ও দেশজ শব্দমিশ্রিত বাংলা বা পুঁথির বাংলা ও সাহিত্য সেই প্রতিষ্ঠা পায় নি । সুতরাং রাজ প্রভাব এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত
চলবে
মুহাম্মদ আবদুর রহমান