সূরা বাকারাহ;(৪০তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ;(৪০তম পর্ব)
সূরা বাকারাহ;(৪০তম পর্ব)

সূরা বাকারাহ’র ১৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“প্রত্যেকের জন্যে একটি দিক আছে যেদিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়, অতএব তোমরা সৎ কাজের দিকে এগিয়ে যাও। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে একত্রিত করবেন, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (২:১৪৮)

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, কেবলা কোন দিকে তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতেও একেক ঐশি ধর্মের জন্য কেবলার দিক ভিন্ন ভিন্ন ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করা। তাই ধর্মের মূল নীতি নয়, এমন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে তারাই প্রিয় যারা সৎকাজ করে। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানদণ্ড হচ্ছে-সৎকাজ। মানুষকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হতে হবে এবং তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে কাজে প্রমাণ দিতে হবে। প্রতিযোগীতা এমন একটি বিষয় যা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কখনও খেলাধুলার ক্ষেত্রে কখনও জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে মানুষ। কিন্তু পবিত্র কোরআন বিশেষ কোন ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ না করে যা কিছু মানুষ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর সেসব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে বলেছে এবং এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে বলেছে। তবে এই প্রতিযোগীতা যেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

এরপর ১৪৯ ও ১৫০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِنَّهُ لَلْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ () وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيْكُمْ حُجَّةٌ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِي وَلِأُتِمَّ نِعْمَتِي عَلَيْكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

“হে নবী, যেখানেই আপনি বের হন, আপনার মুখমন্ডল (নামাজের সময়) কাবা শরীফের দিকে ফেরান। এটা নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে পাঠানো সত্য। (হে মুসলমানরা!) তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন।
হে নবী! (পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি) আপনি যেখান থেকেই বের হন (মাসজিদুল হারাম) পবিত্র মসজিদের দিকে মুখ ফেরাবেন এবং (তোমরা মুসলমানরা) যেখানেই থাক না কেন ওই মসজিদের দিকে মুখ ফেরাও যাতে তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের সাথে বিতর্ক না করে। অতএব তাদেরকে ভয় কর না, শুধু আমাকেই ভয় কর। যাতে আমি তোমাদের জন্যে আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করে দেই এবং তাতে যেন তোমরা সরলপথ প্রাপ্ত হও। (২:১৪৯-১৫০)

এই দুই আয়াতে পুনরায় মক্কার কাবা ঘরকে কেবলা হিসেবে উল্লেখ করে ইসলামের নবী ও মুসলমানদের কাছে এর বিভিন্ন যুক্তি থাকার কথা বলা হয়েছে।

প্রথমতঃ ইহুদীদের ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভয়ের কারণে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ মেনে চলা অনেক মুসলমানের জন্য কঠিন ছিল।

দ্বিতীয়তঃ ঐশীগ্রন্থ অনুসরণের দাবিদাররা তাদের গ্রন্থে এটা পড়েছিল যে ইসলামের নবী দুই কেবলার দিকে নামাজ পড়বেন। যদি এই বিষয়টি বাস্তবায়িত না হতো, তাহলে তারা বলত আসমানী গ্রন্থগুলোতে শেষ নবীর যেসব লক্ষণ বা নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই নবীর মধ্যে সেসব নেই।

‌এরপর ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آَيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ

“(হে মুসলমানরা, আমি আমার সম্পদ বা নেয়ামত তোমাদেরকে পূর্ণভাবে দান করেছি ও তোমাদের মুক্তি বা পথ প্রদর্শনের মাধ্যমগুলো দিয়েছি)-যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করে, তোমাদের পবিত্র করে, গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।” (২: ১৫১)

মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী আয়াতে কেবলা পরিবর্তনের অন্যতম যুক্তি হিসেবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর নেয়ামত পূর্ণভাবে দান করা ও তাদেরকে পথ প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই আয়াতে বলা হয়েছে-মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে আরও অনেক বড় নেয়ামত উপহার দিয়েছেন। আর সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত হলো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী পাঠানো। এই নবীরা ছিলেন জনগণের শিক্ষক। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর আয়াত ও বিধান শিক্ষা দিতেন এবং একজন আন্তরিক প্রশিক্ষক হিসেবে মানুষের সংশোধন ও উন্নয়নের চিন্তা করতেন। নবীরা শুধুমাত্র নৈতিকতা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই মানুষের পরিচালক ছিলেন না, একইসঙ্গে সমাজের চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশ্য ঈমান ও বিশ্বাসের ছায়াতেই তারা জ্ঞান প্রচার করতেন।

এই সূরার ১৫২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

“অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব, তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী হইও না।” (২:১৫২)

আল্লাহ মানুষকে এত নেয়মত ও কল্যাণ দান করেছেন যে তা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। ফলে এসব নেয়ামত তিনি যেভাবে ব্যবহার করলে সন্তষ্ট হন সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত। যদি মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়-তাহলে তার প্রতি আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের কথাও তার মনে থাকে না, এই অবস্থায় আল্লাহও তাকে তার নিজের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন। আল্লাহকে স্মরণ করা বলতে শুধু মুখে মুখে স্মরণ করা বোঝায় না বরং আন্তরিক চিত্তে বাস্তবে তাকে স্মরণ করা বোঝায়। মানুষ যখন পাপে লিপ্ত হবার উপক্রম হয়, তখন সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তা থেকে দূরে থাকে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বলতে শুধু মুখে মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে বোঝায় না। আল্লাহর প্রতি বাস্তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতকে যথাযথ ক্ষেত্রে এবং যে লক্ষ্যে ওইসব নেয়ামত দেয়া হয়েছে ঠিক সে লক্ষ্যেই ব্যবহার করতে হবে।