ফিলিস্তিনে হাজার বছরের প্রাচীন অতিথিশালা

ফিলিস্তিনে হাজার বছরের প্রাচীন অতিথিশালা
ফিলিস্তিনে হাজার বছরের প্রাচীন অতিথিশালা

ইসলামের দৃষ্টিতে আতিথেয়তা ইবাদত। এটা নবী-রাসুলদের সুন্নত, বিশেষ করে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তিনি অতিথির অংশগ্রহণ ছাড়া খাবার গ্রহণ করতেন না। আতিথেয়তার এমন গুণ ধারণ করে আছে ইবরাহিম (আ.)-এর নামে গড়ে ওঠা ফিলিস্তিনের ‘আল খলিল’ শহর।

এখানেই ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আল খলিল শহর সম্পর্কে বলা হয়, ‘যে শহরে কেউ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমায় না।’ কেননা ইবরাহিম (আ.)-এর বরকতে এই শহরের মানুষ অতিথিপরায়ণ এবং এই শহরে আছে তাকিয়ায়ে ইবরাহিম, যা হাজার বছর যাবৎ ক্ষুধার্তদের খাবার পরিবেশন করে আসছে।
আল খলিল শহরে ইবরাহিম (আ.)-এর কবরের পাশেই মসজিদে ইবরাহিম অবস্থিত।

এটিকে পৃথিবীর চতুর্থ প্রাচীন মসজিদ বলা হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের পশ্চিম দিকেই তাকিয়ায়ে ইবরাহিম অবস্থিত। তুর্কি তাকিয়া শব্দের অর্থ রান্নাঘর বা অতিথিশালা। কিছুটা বাংলা লঙ্গরখানার সদৃশ।

ইবরাহিম (আ.)-এর নামে ও সম্মানে প্রতিষ্ঠিত তাকিয়া পরিচালনা করে ফিলিস্তিনের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়। তাকিয়ার পক্ষ থেকে প্রতিদিন ক্ষুধার্ত মানুষের ভেতর খাদ্য বিতরণ করা হয়, বিশেষ করে রমজান মাসে। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাকিয়ায়ে ইবরাহিম প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান কালুন সালেহি। তখন সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর শাসনকাল। তবে আল খলিলের অধিবাসীদের দাবি হলো, তাকিয়ার ধারাবাহিকতা ইবরাহিম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু হয়েছে।

যাকে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে ‘দুই অতিথির পিতা’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। উসমানীয় শাসকরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর তাকিয়ার কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হয়। তখন এর কার্যক্রমে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা, দ্বিনি আলোচনা যুক্ত হয়। তাকিয়ার প্রাচীন ভবনটি ছিল ইবরাহিমি মসজিদের সঙ্গে লাগানো। ১৯৮৪ সালে কয়েক মিটার দূরে নতুন ভবনে এটি সরিয়ে নেওয়া হয়। এই ভবন ২০১৭ সালে তুর্কি সাহায্য সংস্থা টিকার সহযোগিতায় সংস্কার করা হয়। তখন খাবার বিতরণের জন্য হল বরাদ্দ হয় এবং রান্নাঘর প্রশস্ত করা হয়। ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগে তাকিয়ায় একটি গমের মিল ও বেকারি ছিল, যা এখন বন্ধ আছে।
যদিও এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেনা সদস্যদের খাদ্য সরবরাহের জন্য। তবে প্রথম থেকেই অসহায় ও দুস্থ মানুষের মধ্যে তা খাবার বিতরণ করে আসছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পরবর্তী সব মুসলিম শাসক তাকিয়ার কার্যক্রমে সহায়তা করেছেন। যেমন সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) তাকিয়ার নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন। তিনি জেরুজালেম মুক্ত করার পর আল খলিলে ১০টি পরিবারকে নিয়ে আসা হয় এবং তারা ঐতিহাসিক ইবরাহিমি মসজিদ দেখাশোনার দায়িত্ব পায়। সুলতান এই পরিবারগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দেন। যেন কিয়ামত পর্যন্ত তারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এ ছাড়া মিসর, শাম, পূর্ব জর্দান ও সমগ্র ফিলিস্তিন অঞ্চল থেকে তাকিয়া পরিচালনার জন্য সাহায্য পাওয়া যেত। আইয়ুবীয় শাসনামলে তাকিয়ায় প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ হাজার রুটি তৈরি হতো।

তাকিয়ার অধীনে আছে একটি ভাণ্ডার বা গুদাম, দুটি রান্নাঘর এবং নারী-পুরুষের জন্য পৃথক দুটি অপেক্ষা কক্ষ। মানুষের অর্থ সহায়তায় তাকিয়ার ব্যয় নির্বাহ করা হতো। ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অবরোধের কারণে তাকিয়া পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন। তবু ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের কখনো হাত গুটিয়ে নিতে দেয় না। রমজানে রুটি, ভাত ও সবজির সঙ্গে মাংসের তরকারি যুক্ত হয়। রমজান ছাড়া অন্য সময় সপ্তাহে দুই দিন গোশত দেওয়া হয় এবং বাকি দিনগুলোতে সিদ্ধ গমের স্যুপ দেওয়া হয়। তাকিয়ায়ে ইবরাহিম শহরে আসা অতিথি ও পথিকদের জন্য দিনে তিনবার স্যুপ পরিবেশন করা হতো। সকালে, দুপুরে ও বিকালে। খাবার প্রস্তুত হলে তবলা বাজিয়ে তার ঘোষণা দেওয়া হতো। সারা বছর তাকিয়া থেকে ৫০০ মানুষের খাবার সরবরাহ করা হয় আর রমজানে তিন হাজার মানুষ তথা প্রায় ৫০০ পরিবারের খাবার সরবরাহ করা হয়। এখনো বহু অসহায় পরিবার তাকিয়ায়ে ইবরাহিমের ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করছে।

সূত্র : আনাদুলু এজেন্সি, আল মিসরি আল ইয়াউম ও ইউকিপিডিয়া