গহনা বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয় করেন যে শাহজাদি

গহনা বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয় করেন যে শাহজাদি
গহনা বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয় করেন যে শাহজাদি

আধুনিক মিসরের ইতিহাসে যে কয়েকজন মুসলিম নারীকে তাঁদের সেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য স্মরণ করা হয় শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইল তাঁদের অন্যতম। তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ও ভূ-সম্পত্তি দান করেন।

শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইল ৩ জুন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মিসরের উসমানীয় শাসক খেদিভ ইসমাইল পাশার মেয়ে।

তিনি রাজপরিবারের শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলে লেখাপড়া করেন। খেদিভ ইসমাইল পাশাকে বলা হয় মিসরের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জনক। তাঁর শাসনামলে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মিসরে সর্বপ্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি কন্যাশিশুদের শিক্ষা বিস্তারে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।

মেধা, প্রতিভা ও জ্ঞানানুরাগের জন্য খেদিভ ইসমাইল কন্যা ফাতেমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তিনি তাঁকে একাধিক প্রাসাদ ও বিপুল ভূ-সম্পত্তি দান করেন।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইল মিসরের গভর্নর মুহাম্মদ ইসমাইল পাশাকে বিয়ে করেন। বিয়েতে তিনি ৪০ হাজার পাউন্ড মূল্যের মুকুট পরেন এবং তাঁর পোশাকে মূল্যবান হীরা ও মুক্তার কারুকাজ ছিল।

মুহাম্মাদ ইসমাইল পাশার ঔরসে তিনি শাহজাদা জামিল ও শাহজাদি ইসমতের জন্ম দেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় প্রথম স্বামী মারা যান। এরপর তিনি শাহজাদা মাহমুদ সেরি পাশাকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেন। পিতা ও দুই স্বামীর পক্ষ থেকে শাহজাদি ফাতেমা বিপুল পরিমাণ ধন-রত্নের মালিক হন।

ফাতেমা ইসমাইলের বাবা ও দাদা ছিলেন শিক্ষার সেবক। তাঁরা মিসরের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে অনন্য ভূমিকা রাখেন। ফলে তিনি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। মেধাবীদের বিদেশ গমন প্রতিহত করতে এবং আধুনিক সময়ের সঙ্গে মিসরকে এগিয়ে নিতে তিনি মিসরে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পণ করেন। অবশেষে ২১ ডিসেম্বর ১৯০৮ সালে জামিয়া ফুওয়াদ আউয়াল নামে প্রথম মিসরীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে কায়রো বিদ্যালয় নাম দেওয়া হয়।

কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ফাতেমা ইসমাইলের অবদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, একটি ভাড়া করা ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিবছর ভাড়া বাবদ চার শ পাউন্ড পরিশোধ করতে হতো, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভবনটিও যথেষ্ট ছিল না। ভবনের মালিকও তা ভাড়া দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন তা বিক্রি করতে। শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইলের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ উলু পাশা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিস্থিতি তাঁকে জানান। তখন শাহজাদি ফাতেমা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ছয় একর মূল্যবান জমি দান করেন। এ ছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়াতে ডাকাহালিয়ায় অবস্থিত ৬৬১ একর ভূমি দান করেন। এই জমি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক খরচের ৪০ শতাংশ পূরণ হয়ে যেত।

শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইল শুধু ভূমি দান করে শেষ করেননি, বরং সাবের সাবরি পাশা, মাহমুদ ফাহমি বেগের মতো দেশসেরা প্রকৌশলীদের ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা করার দায়িত্ব দেন। ৩১ মার্চ ১৯১৪ মোতাবেক ৩ জমাদাল উলা ১৩২২ হিজরি শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইলের দানকৃত জমিতে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তাতে লেখা ছিল ‘মিসরীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদি ফাতেমা বিনতে ইসমাইল, ১৩২২ হিজরি। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন খেদিভ দ্বিতীয় আব্বাস হেলমি। শাহজাদি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবন নির্মাণের খরচ বহন করবেন, যা ছিল তৎকালীন ২৬ হাজার পাউন্ডের সমান। তিনি এ জন্য অত্যন্ত মূল্যবান কিছু গহনা ও রত্ন পাথর বিক্রি করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরও সব খরচ শাহজাদি ফাতেমা বহন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের সম্মানে কবিতা পাঠ করেন বিখ্যাত কবি আহমদ শাওকি। কবিতায় শাহজাদির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শাহজাদি ফাতেমা মোট দানের পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ (স্বর্ণের) পাউন্ড বলে অনুমান করা হয়।

১৮ নভেম্বর ১৯২০ মহীয়সী এই নারী ইন্তেকাল করেন। দুঃখজনক বিষয় হলো তাঁর অর্থায়নে নির্মিত হলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ব্যবহার দেখে যেতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শাহজাদি ফাতেমা ইসমাইলকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বংশধরদের ডেকে সম্মানিত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিক্রি করা তাঁর গহনাগুলোর ছবি প্রদর্শন করা হয়।

তথ্যঋণ : আলজাজিরা, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া