আগ্রার বিখ্যাত মতি মসজিদ যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল

আগ্রার বিখ্যাত মতি মসজিদ যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল
আগ্রার বিখ্যাত মতি মসজিদ যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল

আগ্রা লাল কেল্লার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঐতিহাসিক মতি মসজিদ। সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর (রহ.) তাঁর রাজত্বের শুরুর ভাগে এটি নির্মাণ করেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। তিনি তাঁর রাজত্বের প্রথম ২৩ বছর দিল্লিতে অবস্থান করেন।

এ সময় মতি মসজিদ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত মসজিদ। ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি দিল্লি ছাড়েন। এরপর আর কখনোই তাঁর দিল্লি ফেরা হয়নি। মসজিদটি নির্মাণ করতে পাঁচ বছর সময় এবং এক লাখ ৬০ হাজার রুপি ব্যয় হয়েছিল।

এটাই ছিল আগ্রা কেল্লার অভ্যন্তরে নির্মিত প্রথম মসজিদ। ঐতিহাসিকরা লেখেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর সভার লোকদের নিয়ে এখানে জোহরের নামাজ আদায় করতেন। মতি মসজিদ মূলত আগ্রা লাল কেল্লার অংশ। সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে লাল কেল্লা তৈরি করেন।

কেল্লার পূর্ব দিকে যেখান থেকে নদীর প্রবাহ দেখা যায়, সেখানে সম্রাটদের প্রাসাদ ছিল। উত্তর দিকে ব্যাবসায়িক কেন্দ্র, দক্ষিণ দিকে নারীদের থাকার স্থান ছিল। দুর্গের পশ্চিম পাশে ছিল দেওয়ানে আম এবং পশ্চিম দিকের প্রবেশপথে ছিল বাজার। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের সময় লাল কেল্লার অন্যান্য অংশের মতো মতি মসজিদও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য পরে ব্রিটিশ সরকার এর পুনর্নির্মাণ করে।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, দিল্লি জামে মসজিদ কিছুটা দূরে হওয়ায় সম্রাট শাহজাহান তাঁর বাসভবনের কাছে মতি মসজিদ নির্মাণ করেন, যেন তিনি সহজেই মসজিদে উপস্থিত হতে পারেন এবং সব সময় জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মতি মসজিদ একটি আয়তাকার দেয়াল দ্বারা ঘেরা, যার দৈর্ঘ্য ২২ মিটার এবং প্রস্থ ১৫ মিটার। মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমের দেয়ালের উচ্চতা ৬.১ মিটার, যাতে রয়েছে তিনটি বাল্ব, সাদা মার্বেল আচ্ছাদিত গম্বুজ এবং একাধিক ছোট মিনার। দেয়ালে আছে পদ্মের কারুকাজ। তবে দুর্গসদৃশ উঁচু দেয়ালের কারণে মূল মসজিদের অনেকটাই আড়াল হয়ে গেছে। পূর্ব দেয়ালে একটি খিলানযুক্ত দরজা দিয়ে একটি ছোট সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করা যায়। মসজিদের সামনের প্রাঙ্গণে মধ্যভাগে অজুখানা ও পানির হাউস রয়েছে। মূল মসজিদ, মসজিদের প্রাঙ্গণ ও অজুখানা—সবই সাদা মার্বেল পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত।

মূল প্রার্থনাকক্ষটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রার্থনাকক্ষটিও সাদা মার্বেল পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রার্থনাকক্ষের ওপর তিন শিরাবিশিষ্ট গম্বুজ ছিল, যা সাদা মার্বেল পাথর পরিহিত ছিল। এর ওপর পিতলের কারুকাজ ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় গম্বুজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভেঙে পড়ে। এ সময় একদল ব্রিটিশ সেনা গম্বুজের তামার কারুকাজ নিলামে বিক্রি করে দেয়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ব্রিটিশ সরকার একটি অস্থায়ী গম্বুজ তৈরি করে। মসজিদের দেয়াল, মিহরাব, গম্বুজ, মিনারে বাহারি নকশা ও পাথরের কারুকাজ দেখা যায়। পূর্ব দেয়ালের দরজায় পিতলের কারুকাজ রয়েছে। মূল মসজিদের মেঝেতে কালো মার্বেল পাথর দ্বারা জায়নামাজের মতো নকশা করা হয়েছে, যা মুসল্লিরদের নামাজের জায়গা চিহ্নিত করে।

মতি মসজিদ সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর একটি, যা একই সঙ্গে ধর্মীয় গাম্ভীর্য ও রাজকীয় ঐশ্বর্যের ধারক। মার্বেলের ওপর সূক্ষ্ম কারুকাজ, জ্যামিতিক নকশা, ভারতীয় পদ্ম ও লতার কারুকাজ তাঁর সময়ে শিল্পের বিকাশ সম্পর্কে ধারণা দেয়। বিশেষত যারা সম্রাট আওরঙ্গজেবকে শিল্প-সাংস্কৃতির বিরোধী আখ্যা দেয় এই মসজিদ তাদের মত প্রত্যাখ্যান করে। তবে মতি মসজিদ নিয়ে ঐতিহাসিকদের ভিন্নমতও আছে। কারো কারো মতে, সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নবাব বাঈয়ের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। সম্রাজ্ঞী ও প্রাসাদের নারীরাই মূলত সেখানে নামাজ আদায় করত।

তথ্যঋণ : আর্কনেট ডট অর্গ ও উইকিপিডিয়া