পবিত্র কোরআনে মায়ের আত্মত্যাগের বর্ণনা

পবিত্র কোরআনে মায়ের আত্মত্যাগের বর্ণনা
পবিত্র কোরআনে মায়ের আত্মত্যাগের বর্ণনা

সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে মা-ই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। গর্ভধারণ, দুধ পান, রাত জেগে সন্তানের তত্ত্বাবধানসহ নানাবিধ কষ্ট একমাত্র মা-ই সহ্য করেন। তা ছাড়া সন্তানের প্রতি মা-ই সবচেয়ে বেশি যত্নবান ও বেশি আদর-সোহাগ করে থাকেন।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ সন্তানের জন্য মায়ের ত্যাগের কথা উল্লেখ করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং অতিকষ্টে তাকে প্রসব করেছেন। তার গর্ভধারণ ও দুধ পান ছাড়ানোর সময় লাগে ৩০ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং ৪০ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার ওপর ও আমার মা-বাবার ওপর যে নিয়ামত দান করেছ, তোমার সে নিয়ামতের যেন আমি কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি এবং আমি যেন ভালো কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো।

আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। ’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ১৫)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে।

আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো। ’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৪)
এ জন্য ইসলাম ধর্মে মাকে সর্বোচ্চ সম্মানের মুকুট পরানো হয়েছে। নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরাম মায়ের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে আহবান করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা বলেন, এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বলেন, তোমার মা। লোকটি বলল, অতঃপর কে? নবী (সা.) বলেন, তোমার মা।

সে বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বলেন, তারপর তোমার বাবা। (বুখারি, হাদিস : ৫৯৭১)
অন্য একটি হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, মায়ের পদতলে জান্নাত। এমনকি এক সাহাবিকে তিনি জিহাদে না নিয়ে মায়ের সেবায় নিয়োজিত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, মুআবিয়া ইবনে জাহিমা সালামি (রহ.) থেকে বর্ণিত, আমার বাবা জাহিমা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। এখন আপনার কাছে পরামর্শ করতে এসেছি। তিনি বলেন, তোমার মা আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তাঁর খিদমতে লেগে থাকো। কেননা জান্নাত তাঁর দুই পায়ের নিচে। (নাসায়ি, হাদিস : ৩১০৪)

মা-বাবার সম্মানের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে আল্লাহর ইবাদত করার পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের উফ বোলো না এবং তাঁদের ধমক দিয়ো না; তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বোলো। (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মা-বাবার আদব, সম্মান এবং তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সঙ্গে একত্র করে ফরজ করেছেন। মহান আল্লাহর ইবাদত করা যেমন প্রতিটি মানুষের জন্য ফরজ, তেমনি মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করাও ফরজ।

এ কারণে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের শুকরিয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেন, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৪)

পবিত্র হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, কোনো এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করল, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বলেন, সময় হলে নামাজ পড়া। সে আবার প্রশ্ন করল, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বলেন, মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার। (মুসলিম, আয়াত : ৮৫)

মা-বাবা যদি অমুসলিমও হন, তবু তাঁদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। তাঁদের আদর-আপ্যায়ন করতে হবে। আসমা (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, আমার জননী মুশরিকা। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁকে আদর-আপ্যায়ন করা জায়েজ হবে কি? তিনি বলেন, ‘তোমার জননীকে আদর-আপ্যায়ন কোরো।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০০৩)

তবে তাঁরা যদি এমন কাজ করতে আদেশ করেন, যা করলে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করতে হয়, বা কুফরি করতে হয়, তবে সেই কাজ করার অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিচ্ছি তার মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে ওঁরা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করেন আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাঁদের মেনো না।’ (সুরা আল-আনকাবুত, আয়াত : ৮)

আল্লাহ আরেক জায়গায় বলেন, ‘তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করেন আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাঁদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাঁদের সঙ্গে বসবাস করবে সত্ভাবে।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৫)

অর্থাৎ যার মা-বাবা অমুসলিম এবং তাকেও অমুসলিম হওয়ার আদেশ করেন, এ ব্যাপারে তাঁদের আদেশ পালন করা জায়েজ নয়, কিন্তু দুনিয়ায় তাঁদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হবে। বলা বাহুল্য, আয়াতে ‘মারুফ’ বলে তাঁদের সঙ্গে আদর-আপ্যায়নমূলক ব্যবহার বোঝানো হয়েছে।

তাই আসুন, আমরা মা-বাবাকে সম্মান করি, যথাসম্ভব তাঁদের খিদমত করি, তাঁদের জন্য সর্বদা দোয়া করি। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।