গাজা নগরীর অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য

গাজা নগরীর অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য
গাজা নগরীর অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গাজা উপত্যকা ইসরায়েল ও মিসর সীমান্তে অবস্থিত। মাত্র ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই ভূমিতে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি মুসলিম বসবাস করে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত গাজা নগরীর ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে গাজা নগরী এক মিশ্র সংস্কৃতির কেন্দ্র।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে প্রাচীন মিসরীয়রা গাজা অঞ্চল শাসন করত। এরপর ফিলিস্তিন অঞ্চলে একে একে আসারিয়ান, গ্রিক, হেলেনিস্টিক, সেলিউসিড, হাসমোনিয়াস, পার্সিয়ান, রোমান ও মুসলমানদের আগমন ঘটে। লৌহ যুগে গাজা অঞ্চলে মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটলেও খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে নগর হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় কেনআনি সম্প্রদায়ের হাতে। কেনআনি সম্প্রদায় থেকে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে।
গাজা ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি।

গাজা নগরীর ধর্মীয় গুরুত্ব

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা ফিলিস্তিন ভূমির মর্যাদা প্রমাণিত হয়। পবিত্র এই ভূমির অংশ হিসেবে গাজা উপত্যকাও এই মর্যাদার অধিকারী। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কোরো এবং পশ্চাদসরণ কোরো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) গাজা বিজয়কারী বাহিনীকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি গাজা ও আস্কালানের বরপুত্রদের সুসংবাদ দিচ্ছি।’ (দাইলামি : ২/২৭০)

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যদি পথ অবরুদ্ধ না হতো এবং আস্কালানবাসীর কষ্ট না হতো, তবে আমি তোমাদের তার মর্যাদা ও গুরুত্ব বর্ণনা করতাম।’ (কিতাবুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৫৩)

আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.) বলেন, ‘প্রতিটি অঞ্চলের একটি কেন্দ্র থাকে। শামের কেন্দ্রভূমি আস্কালান।

’ (কিতাবুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৫৩)
আস্কালান প্রাচীন গাজারই একটি অংশ।

গাজা নগরীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ফিলিস্তিন নবী-রাসুলদের স্মৃতিধন্য পবিত্র ভূমি। এ ভূমিতে অসংখ্য নবী-রাসুল আগমন করেন। মিরাজের রাতে বায়তুল মুকাদ্দাসে আল্লাহ সব নবী-রাসুলকে সমবেত করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতিবেশী শহর হিসেবে গাজায়ও নবী-রাসুলদের বিচরণ ছিল বলে অনুমান করা যায়। ঐতিহাসিকরা বলেন, শোআইব (আ.) কেনআনের অধিবাসী ছিলেন এবং মুসা (আ.) মিসর থেকে কেনআনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর কেনআনিদের আবাসভূমি ছিল গাজা। আল্লামা মুজিরুদ্দিন হাম্বলি (রহ.) লেখেন, ‘গাজা বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতিবেশী শহরগুলোর ভেতর সবচেয়ে সুন্দর শহর। এখানে সুলাইমান বিন দাউদ (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরিস আশ-শাফেয়ি (রহ.) এখানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান এখনো চিহ্নিত আছে।’ (আল ইনসুল জালিল বিতারিখিল কুদসি ওয়াল খালিল : ২/৪২২)

আরব উপদ্বীপের সঙ্গে গাজা নগরীর সম্পর্ক

সুপ্রাচীনকাল থেকে আরব উপদ্বীপের সঙ্গে গাজা নগরীর সম্পর্ক ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ খ্রিস্টাব্দে গ্রিকরা সমুদ্রতীরবর্তী গাজা নগরীকে বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। আরবরা শাম অঞ্চলে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যাতায়াতের সময় গাজা নগরীতে বাণিজ্য করতে যেত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেহেতু কুরাইশের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মের সফরে।’

(সুরা : কুরাইশ, আয়াত : ১-২)

তাফসিরবিদরা বলেন, আয়াতদ্বয়ে আরবদের শীত ও গ্রীষ্মকালে শামে পরিচালিত বাণিজ্য সফরের কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে গ্রীষ্মকালীন সফরটি গাজার ওপর দিয়ে পরিচালিত হতো। কেননা গাজায় ছিল প্রাচীন শাম অঞ্চলের প্রথম শহর।

ইসলামপূর্ব যুগে গাজা নগরী

প্রাচীনকাল থেকেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রাচীনকাল থেকেই গাজার বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। প্রাচীন মিসরীয় সাম্রাজের আমলে গাজা ছিল কেনআন প্রদেশের রাজধানী। মিসরীয় গভর্নররা এ শহরেই বসবাস করতেন। সাড়ে তিন শ বছর মিসরীয়দের শাসনাধীন থাকার পর ফিলিস্তিনিরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং গাজাসহ ফিলিস্তিন অঞ্চলে পাঁচটি নগর রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাঁচ নগর রাষ্ট্র মিলে একটি রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠিত হয়। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকের শুরুর ভাগে জেরুজালেমে দাউদ (আ.) স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে গাজা তার অন্তর্ভুক্ত হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব ৭৩০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩০ থেকে ৫৬৮ পর্যন্ত এই অঞ্চলে সংক্ষিপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাসারিয়ান, মিসরীয় ও পারস্যের শাসকরা। ব্যাবিলনের শাসক নেবুচাদ নেজার ৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে গাজা দখল করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট গাজা দখল করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ খ্রিস্টাব্দে গাজা রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী বাইজান্টাইনদের কাছ থেকে গাজা বিজয় করেন। (উইকিপিডিয়া)

গাজা নগরী থেকেই ফিলিস্তিন বিজয়ের সূচনা

মুসলমানদের ফিলিস্তিন বিজয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে গাজা উপত্যকার নাম। কেননা এই উপত্যকা বিজয়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। ফিলিস্তিন অঞ্চলে মুসলিম বাহিনী সর্বপ্রথম রোমান বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল গাজার ‘দায়িন’ গ্রামে। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করার পর মুসলিম বাহিনী সর্বপ্রথম গাজা উপত্যকা উদ্ধার করেছিল। উস্তাদ মুহাম্মদ কুর্দ আলী লিখেছেন, ‘১২ হিজরিতে গাজার গ্রাম দায়িনে সর্বপ্রথম রোমান ও মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয়েছিল। সেটা ছিল তাদের অবস্থান ও গাজা নগরীর মধ্যবর্তী স্থানে। উভয় বাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং রোমানরা পরাজিত হয়। ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান (রা.) পরাজিত বাহিনীর পশ্চাত্ধাবন করেন। তিনি সংবাদ পান ফিলিস্তিনের আরাবা শহরে রোমান সেনারা সমবেত হয়েছে। তিনি সেখানে আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করেন।’

(খুতাতুশ শাম : ১/৮৪)

মধ্যবর্তী সামান্য কিছু সময় ছাড়া (১১০০-১২৭৭ খ্রি.) মুসলমানদের ফিলিস্তিন বিজয়ের সময় থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত গাজা নগরী মুসলমানদেরই অধীনে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয়রা পরাজিত হলে গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী গাজা উপত্যকার ওপর মুসলিম ফিলিস্তিনিরা সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। (উইকিপিডিয়া)