সূরা বাকারাহ;(পর্ব ২১)

সূরা বাকারাহ;(পর্ব ২১)
সূরা বাকারাহ;(পর্ব ২১)

সূরা বাকারাহ’র ৫৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

 

“(হে বনী ইসরাইল!) আমি তোমাদের ওপর মেঘ দ্বারা ছায়া দান করেছিলাম এবং তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া প্রেরণ করেছিলাম। আর বলেছিলাম তোমাদের যে জীবিকা দান করলাম সেই পবিত্র বস্তু হতে খাও। তারা (আমার নির্দেশ অমান্য করে) আমার কোন অনিষ্ট করেনি বরং নিজেদেরই অনিষ্ট করেছিল।” (২:৫৭)

মহান আল্লাহ ফেরাউনের কবল থেকে বনী ইসরাইলকে রক্ষা করার পর তাদেরকে ফিলিস্তিনে যাবার নিদের্শ দেন। কিন্তু সেখানে অত্যাচারীদের শাসন ব্যবস্থা বিরাজ করছে এই অজুহাত দেখিয়ে ইহুদীরা সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে আল্লাহর ক্রোধ তাদেরকে ঘিরে ফেলল। অর্থাৎ তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এল এবং প্রায় ৪০ বছর ধরে তারা সিনাই উপত্যকায় ভবঘুরের মত ও অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াল। এই দীর্ঘ সময়ে অবশ্য তাদের অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হলো এবং মহান আল্লাহ পুনরায় তাদের ওপর দয়া করলেন। আর ওই দয়া ও অনুগ্রহের কথাই এ আয়াতে বলা হয়েছে। ওই তপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির ওপর ছায়াদান ছাড়াও আল্লাহ তাদেরকে সেখানে দু’ধরনের খাবার দিচ্ছিলেন। প্রথম ধরনের খাবার ছিল মধু জাতীয় এক ধরনের খাবার যা গাছের রস থেকে তৈরি হতো। এ খাবারকে বলা হতো মান্না। আর সালওয়া অর্থাৎ দ্বিতীয় ধরনের খাবার ছিল কবুতর জাতীয় এক ধরনের পাখি।

এরপরের আয়াতে অর্থাৎ ৫৮নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوا هَذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُولُوا حِطَّةٌ نَغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ وَسَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ

“স্মরণ কর যখন তোমাদের বলেছিলাম এই শহর অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছে স্বাচ্ছন্দে আহার কর। দরজার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার সময় নত শিরে প্রবেশ কর এবং বল আমরা আমাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই। তাহলে আমি তোমাদের ক্ষমা করব এবং অচিরেই ভালো লোকদেরকে অতিরিক্ত দান করব।” (২:৫৮)

ইহুদীরা সিনাই উপত্যকায় ৪০ বছর ধরে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ায়। এরপর তাদের পাপ ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’লা তাদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ‘হেত্বাতুন’ শব্দটি বার বার উচ্চারণ করতে বললেন। এই শব্দের অর্থ হলো,আমাদের পাপ বা গোনাহগুলো মুছে ফেল ও আমাদেরকে ক্ষমা কর। এই আয়াত থেকে এটাও বোঝা গেল যে,পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশের সময় বিশেষ সম্মান বা ভক্তি প্রদর্শন জরুরী। আর প্রার্থনা এবং ক্ষমা প্রার্থনার বাক্য ও রীতিও আল্লাহর কাছ থেকে শিখতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইহুদীদের পক্ষ থেকে কুৎসিত পন্থায় আল্লাহর আদেশ অমান্যের কথা বলা হয়েছে।

সুরা বাকারাহ’র ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ

“কিন্তু যারা অন্যায় করেছিল,তারা তাদের যা বলা হয়েছিল,তার পরিবর্তে অন্য কথা বলল। তাই অনাচারীদের প্রতি আমি আকাশ হতে শাস্তি প্রেরণ করলাম যেহেতু তারা সত্য ত্যাগ করেছিল।” (২:৫৯)

অপরাধী ইহুদীদের অনেকে বিদ্রুপের ছলে হেত্বাতু অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা ভুল করেছি বা ক্ষমা করে দাও” বলার পরিবর্তে হেনত্বাতু শব্দটি উচ্চারণ করেছিল,যার অর্থ হলো গম। আল্লাহর নির্দেশকে এভাবে খেলাচ্ছলে গ্রহণ করায় তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে এবং তাদের মধ্যে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আয়াতে এটা স্পষ্ট যে,শুধু আদেশ অমান্যকারী ওপরই এই রোগ বা শাস্তি নেমে এসেছিল,সবার ওপর নয়। এই আয়াত থেকে এটা বোঝা যায়,যে সমাজের মানুষ সত্য থেকে পলায়নের চেষ্টা করে বা সত্যকে অমান্য করে কিংবা এ ব্যাপারে ঔদ্ধত্য দেখায়, সেই সমাজের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এরপর ৬০নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذِ اسْتَسْقَى مُوسَى لِقَوْمِهِ فَقُلْنَا اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَشْرَبَهُمْ كُلُوا وَاشْرَبُوا مِنْ رِزْقِ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ

“যখন মূসা নিজ সম্প্রদায়ের জন্য পানি প্রার্থনা করল। আমি বললাম,তোমার লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত কর। ফলে তা থেকে ১২টি ঝর্ণা প্রবাহিত হলো। প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ ঘাট অর্থাৎ পানস্থান জেনে নিল। তাদেরকে বললাম,আল্লাহর জীবিকা থেকে খাও ও পান কর এবং পৃথিবীতে শান্তি ভঙ্গ করে বেড়িও না।” (২:৬০)

যদিও হযরত মূসা (আ.) বনী ইসরাইলের কাছে প্রেরিত নবী বা পয়গম্বর ছিলেন এবং তার মূল দায়িত্ব ছিল আল্লাহর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐশী পথ-প্রদর্শকরা মানুষের পার্থিব কল্যাণ ও পার্থিব সমস্যা নিয়েও চিন্তা করেন। তাই হযরত মূসা (আ.) তার জাতির জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে তাদেরকে পানি দান করেন। এজন্যে তিনি হযরত মূসা (আ.)কে তার সেই লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করতে বলেন,যে লাঠির আঘাতে তিনি নীল দরিয়ায় শুকনো পথ সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে আল্লাহ তাদের এটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে,তার নবী যেকোন কাজ করতে সক্ষম। বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধরদের মধ্যে ১২টি গোত্র বা গোষ্ঠী ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের জন্য ১২টি ঝর্ণা বা প্রস্রবন সৃষ্টি হলো, যাতে প্রত্যেক গোত্র আলাদাভাবে পানি পেতে পারে এবং পানির সংকট দেখা না দেয়। এভাবে আল্লাহ একদিকে মান্না ও সালওয়া খাবার পাঠিয়ে এবং অন্যদিকে যথেষ্ট পানির ব্যবস্থা করে ইহুদী জাতির কল্যাণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যাতে তারা পাপাচার,নৈরাজ্য ও হঠকারিতা থেকে দূরে থাকতে পারে।

সূরা বাকারাহ’র ৫৭,৫৮,৫৯,৬০ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-

এক. আল্লাহ মানুষের জীবিকা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তাই বলে পশুর মত যে কোন পন্থায় পেট ভরানোর চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। তাই মানুষ হিসাবে আমাদেরকে হালাল রিযিকের সন্ধান করতে হবে। যেমনটি সূরা বাকারাহ’র ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-‘তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করলাম সেই পবিত্র বস্তু হতে খাও।’

দুই. আল্লাহ ক্ষমাশীল। কিন্তু তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনা হতে হবে আন্তরিকভাবে। অন্তর থেকে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে মৌখিকভাবেও ক্ষমা স্বীকার করতে হবে। যেমন সূরা বাকারাহ’র ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-নত শিরে প্রবেশ কর এবং বল আমরা ক্ষমা চাই।

তিন. আল্লাহর ইবাদত বা নির্দেশ যথাযথভাবে বা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতে হবে। তা না হলে তা পূর্ণ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না বরং তা হবে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবমাননা ও ঐদ্ধত্য বা হঠকারিতা প্রকাশ।