রাসুল (সা.)-এর চিরন্তন শান্তি নীতি

রাসুল (সা.)-এর চিরন্তন শান্তি নীতি
রাসুল (সা.)-এর চিরন্তন শান্তি নীতি

মুহাম্মদ (সা.)। এটি শুধু কোনো একজন ব্যক্তির নাম নয়, এটি দুনিয়াজোড়া শান্তির অমোঘ বাণী ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক বিস্ময় মানবের নাম। যিনি জাহেলি আরবের তমসাচ্ছন্নতায় ভর করা পাপিষ্ঠ আত্মাগুলো কলুষমুক্ত করেছিলেন আদর্শিক সংগ্রামের মাধ্যমে, তৈরি করেছিলেন ন্যায়ের অমেয় দৃষ্টিপট, ছড়িয়েছিলেন শান্তির অমোঘ বার্তা, প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা! তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কিছু বিষয়ের প্রবর্তক ছিলেন, যে বিষয়গুলো দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করেছেন। যেমন—

১. ইতিহাসের প্রথম শান্তি-সংঘ প্রতিষ্ঠা : প্রাক-ইসলামী যুগে আরব ছিল ঘোর তমসাবৃত, ত্রাহি ত্রাহি রবে কাঁদছিল মানুষের বাঁচা-মরার নিরেট মর্মবাণী।

তখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। সেই সময়ে হারবুল ফুজ্জারের ভয়াবহতা ও তৎকালিক আরব সমাজের সার্বিক অবক্ষয় পর্যবেক্ষণ করে রাসুল (সা.) নবুয়তপ্রাপ্তির ১৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের একটি সামাজিক সংঘ। ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম শান্তি-সংঘ। (সূত্র : মুহাম্মদ : হিজ লাইফ বেইজড অন দ্য আরলিয়েস্ট সোর্সেস/মার্টিন, পৃষ্ঠা ৩১; আকবর শাহ, দ্য হিস্টোরি অব ইসলাম, (দারুসসালাম পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ১০১)
২. ‘সাধারণ ক্ষমা’ নীতির প্রবর্তক : অষ্টম হিজরির দশম রমজানে রাসুল (সা.) মক্কাভিমুখী রওনা হন, সঙ্গে ১০ হাজার মুজাহিদ সাহাবা।

তিনি যথাসম্ভব রক্তপাত এড়িয়ে মক্কায় প্রবেশের কৌশল করেছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘কুরাইশদের মধ্যে যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, নিজ নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখবে, তারা নিরাপদ।’
ক্ষমতা হাতে নিয়ে তিনি প্রতিশোধস্পৃহা দমিয়ে রেখে সব ঘোরতর শত্রু ‘সাধারণ ঘোষণা’ করেন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার একচেটিয়া ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।

যদিও এর আগে একই কাজ করেছিলেন ইউসুফ (আ.)।
৩. গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রথম বিরোধ নিষ্পত্তি : পবিত্র কাবাঘর পুনর্নিমাণের পর হাজরে আসওয়াদ আগের জায়গায় কে বসাবে—এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। অত্যাসন্ন রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের সমূহ সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে ৩৫ বছর বয়সী আল-আমিন চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে এলেন। নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন এবং দ্বন্দ্বের সফল পরিসমাপ্তি ঘটান। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-২/২৬৩)

৪. প্রথম দ্বিপক্ষীয় চুক্তি : ষষ্ঠ হিজরি।

মক্কার সার্বিক পরিস্থিতি বাহ্যত মুসলমানদের অনুকূলে, পবিত্র কাবাঘর তখনো কুরাইশদের দখলে। রাসুল (সা.) তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রায় এক হাজার ৫০০ সাহাবি নিয়ে ষষ্ঠ হিজরির ১ জিলকদ মক্কাভিমুখে ওমরাহ পালনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৪৫)
মক্কার পার্শ্ববর্তী ‘হুদায়বিয়া’ নামক স্থানে যথারীতি যাত্রাবিরতি করলেন। কিন্তু কুরাইশরা তাঁদের পূর্বশত্রুতার জের ধরে মুসলিম বাহিনীকে সম্মুখে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করলেন। আর ঠিক সময়ে উভয় পক্ষীয় সমঝোতায় একটি লিখিত শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির বেশির ভাগ শর্ত মুসলিমদের প্রতিকূলে হওয়া সত্ত্বেও ঐশীজ্ঞানের পবিত্র ইশারায় রাসুল (সা.) মুসলমানদের চুক্তিনামা নির্দ্বিধায় মেনে নিতে বলেন। আর কোরআনে এটিকে ‘ফাতহুম মুবীন’ অর্থাৎ সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (সুরা : ফাতাহ, আয়াত : ০১)

ঐতিহাসিকরা এই চুক্তিপত্রকে মুসলিমদের বিজয়ের প্রাথমিক সিগন্যাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৩৫৩)

৫. প্রথম লিখিত সংবিধান রচনা : ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর রাসুল মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন মানুষের সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা নাজুক ও ভয়াবহ। এমনকি তৃণমূল পর্যায়েও অন্যান্য গোত্রীয় কলহ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় মদিনায় বসবাসরত সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) ৪৭ ধারার একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। তৎকালীন সময়ে ৪৭ বা ৫৩ ধারার একটি আইন রচনা করা অত্যন্ত দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন কাজ ছিল। ইবনে হিশামের মতে, এই সনদের ৫৩টি ধারা আছে। উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াটের মতে, এই সনদের ধারার সংখ্যা ৪৭টি।