মীর জুমলার ঢাকা গেট

মীর জুমলার ঢাকা গেট
মীর জুমলার ঢাকা গেট

মীর জুমলার গেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি ঐতিহাসিক মোগল স্থাপত্য নিদর্শন। এই গেটটি ঢাকা গেট, ময়মনসিংহ গেট নামেও পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কার্জন হল ছাড়িয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির পথে নজরে আসে হলুদ রঙের মীর জুমলার তোরণ। এ গেটের তিনটি অংশের একটি রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, মাঝখানের অংশ পড়েছে রোড ডিভাইডারের মাঝে এবং অপর অংশটি রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে তিন নেতার সমাধিসৌধের পাশে।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ইসলাম খাঁর (প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দিন চিশতি, ১৫৭০-১৬১৩ খ্রি.) আমলে রমনা অঞ্চলে ছিল বাগে বাদশাহি নামক মোগল উদ্যান। বাগে বাদশাহির প্রবেশপথে দুটি স্তম্ভ্ভ ছিল। তা-ই পরে পুনর্নির্মাণ করে নামকরণ করা হয় ঢাকা গেট। বলতে হয়, ইসলাম খাঁ ছিলেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রথম গভর্নর, সুবাদার ও মোগল সাম্রাজের সেনাপতি।

সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর উপাধি দেন ইসলাম খান।
মোগল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় ঢোকার ‘প্রবেশমুখ’ ছিল এ তোরণ। বলা হতো ‘মীর জুমলার গেট’। পরে কখনো ‘ময়মনসিংহ গেট’, কখনো ‘ঢাকা গেট’, কখনো ‘রমনা গেট’।

সরকারি গেজেট অনুযায়ী এ তোরণ ও আশপাশের এলাকার নাম ‘মীর জুমলার গেট’।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার সুবাদার ছিলেন মীর জুমলা (১৫৯১- ১৬৬৩ খ্রি.)। তিনি ঢাকাকে স্থলপথে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ও ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে ১৬৬০ খ্রি. থেকে ১৬৬৩ খ্রি. একটি তোরণ নির্মাণ করেন। গড়েন গেটসংলগ্ন এলাকায় নয়নাভিরাম বাগান ‘বাগ-ই-বাদশাহি’। উদ্যানটি ইসলাম খাঁর আমলে ছিল রমনা অঞ্চলে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পুরনো হাইকোর্ট)।

হাইকোর্ট ভবনের পূর্বকোণে একই ধরনের দুটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল। মূলত সে সময় এ স্তম্ভের মধ্য দিয়ে ছিল হাতির চলাচল। ব্রিটিশ আমলে জায়গাটি ঘোড়দৌড়ের জন্য ব্যবহৃত হতো, নাম হয় ‘রেসকোর্স ময়দান’। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ নামকরণ এবং বর্তমানে যা ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় পার্ক।
প্রায় ৪০০ বছরের বাংলার ঐতিহ্য এ স্থাপনাটি প্রায় ধ্বংসের পথে। এখনো যতটুকু টিকে আছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হবে না এই সেই মীর জুমলার ঢাকা গেট।

ঢাকা গেটে নির্মিত প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ স্তম্ভ খুবই বিরল। যার ওপরে রয়েছে কারুকার্যমণ্ডিত চারকোণ বিশিষ্ট শেড। পশ্চিম পাশের বড় স্তম্ভের পাশেই আছে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি স্তম্ভ। যার মাঝে টানা অবস্থায় আছে একটি দেয়াল। উঁচু থেকে নিচুতে নামা এ দেয়ালটি প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু পূর্বপাশের বড় স্তম্ভের সঙ্গে দেয়াল বা প্রাচীর থাকলেও নেই ছোট স্তম্ভ। একটি গেটের সামনে একদল হাতি, পেছনে সবুজ গাছপালা, মন্দিরের একটি চূড়া ঢাকা গেটের এমন ছবি ঘুরেফিরে ইন্টারনেটে দেখা যায়। তবে বর্তমানে স্থাপনাটির বর্তমান অবস্থা দেখলে সচেতন যে কেউ হতাশ হবেন।

এই গেটের গা-ঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে মেট্রো রেল, একে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন গবেষকরা। তবে উল্টো কথাও আছে নির্মাতাদের। গেটটির ভগ্নদশা দেখলে মনে হবে, যেন গেটটির দেখাশোনায় কর্তৃপক্ষীয় দায় নেই কারো। মীর জুমালার ঢাকা গেট এখন কেবলই ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি অভ্যর্থনা স্মারকচিহ্ন।

নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের কী জবাব থাকবে যদি স্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যায় ঐতিহ্যের স্থাপত্য নিদর্শন: মীর জুমলার ঢাকা গেট? অবাক হওয়ার কিছু নেই, স্থাপত্য প্রয়োজন বা জনস্বার্থে যদি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকা গেট! আশার কথা, ঢাকা গেটের নান্দনিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার প্রয়াশও আছে অব্যাহত। মীর জুমলা গেট ফিরে পাক ময়মনসিংহ গেট বা ঢাকা গেটের হৃত ঔজ্জ্বল্য।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক

কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর