আ’ইয়াদ – ই শা’বানীয়াহ্ : শা’বানের ঈদ ও উৎসব সমূহ :

আ'ইয়াদ - ই শা'বানীয়াহ্ : শা'বানের ঈদ ও উৎসব সমূহ :
আ’ইয়াদ – ই শা’বানীয়াহ্ : শা’বানের ঈদ ও উৎসব সমূহ :

শা’বান মাস খুবই মর্যাদা সম্পন্ন ( শরীফ ) মাস । এ মাস হযরত সাইয়েদুল আন্বিয়া মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহর ( সা ) সাথে একান্ত সংশ্লিষ্ট। তিনি ( সা ) বলতেন : শা’বান আমার মাস ।

শা’বান মাস খুবই মর্যাদা সম্পন্ন ( শরীফ ) মাস । এ মাস হযরত সাইয়েদুল আন্বিয়া মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহর ( সা ) সাথে একান্ত সংশ্লিষ্ট। তিনি ( সা ) বলতেন : শা’বান আমার মাস । যে ব্যক্তি আমার মাসের যে কোনো একদিন রোযা রাখবে বেহেশত তার জন্য ওয়াজিব ( অবধারিত ) হয়ে যাবে । স্বয়ং মহানবী (সা) এ মাসে রোযা রাখতেন এবং তিনি রমযান মাসের আগমণ পর্যন্ত গোটা শা’বান মাস একটানা রোযা রেখে যেতেন । শা’বানের মাসের সর্বসাধারণ অর্থাৎ প্রত্যহ পালনীয় আমল এবং বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে পালনীয় বিশেষ বিশেষ আমল দুআর কিতাবাদিতে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ কিছু ঈদ ও উৎসবের জন্য শা’বান মাস আনন্দঘন মাস । নীচে আ’ইয়াদ – ই শাবানীয়াহ উল্লেখ করা হল :

৩ শা’বান : সাইয়েদুশ শুহাদা ( শহীদদের নেতা ) সাইয়েদু শাবাব – ই আহলিল জান্নাহ ( বেহেশত বাসী যুবকদের নেতা ) হযরত আবু আব্দিল্লাহ ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর ( আ) শুভ জন্মদিন । ইমাম হুসাইন ( আ ) যেহেতু নিজের জীবন – প্রাণ ,আপনজন ও সঙ্গী সাথীদের উৎসর্গ করে ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন সেহেতু ইমাম হুসাইনের পূণ্য স্মৃতিকে স্মরণীয় ও চিরজাগরুক রাখার জন্য ইরানে এ দিন ( ৩ শাবান) রুযে পসদর ( ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী দিবস ) ঘোষিত হয়েছে এবং উদযাপিত হয় ।

৪শা’বান : কারবালায় ইমাম হুসাইনের ( আ) সিপাহসালার , পতাকাবাহী ও নরশার্দুল মহাবীর ক্বামার – ই বনী হাশিম ( বনী হাশিমের চাঁদ ) হযরত আলী ইবনে আবী তালিবের ( আ ) পুত্র আবুল ফাযল আব্বাসের (আ ) শুভ জন্মদিন। এ দিন কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর পরিবারের জন্য তাঁর অপার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ইরানে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে রুমে জনবয্ ( যুদ্ধাহত ও আত্মত্যাগীদের দিবস ) ।

৫ শা’বান : সাইয়েদুস সাজিদীন ( সিজদাহকারীদের নেতা ) যাইনুল আবিদীন ( ইবাদতকারীদের শোভা ও সৌন্দর্য) আহলুল বাইতের ( আ ) ১২ মাসুম ইমামের চতুর্থ মাসূম ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন ( আ ) আস – সাজ্জাদের ( অধিক অধিক সিজদাহকারী ) শুভ জন্মদিন। ইমাম সাজ্জাদ ( আ ) ইমাম হুসাইনের পুত্র । মহান আল্লাহর কাছে দুআ, প্রার্থনা ও মুনাজাতের মাধ্যমে ইমাম যাইনুল আবিদীন ( আ ) তৎকালীন যালিম ও অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে কারবালার মহা বিপর্যয় পরবর্তী যালেম বনী উমাইয়া খিলাফত কর্তৃক সৃষ্ট চরম ভয়ানক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করেছেন এবং মহান আল্লাহর খাঁটি তৌহিদ ( একত্ববাদ ) , তাঁর নৈকট্য অর্জন এবং তাঁর ওপর ভরসা ও নির্ভর করে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা লাভের শিক্ষা স্বীয় অনুসারীদের দিয়েছেন । তাই তাঁর দুআ ও প্রার্থনাসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম । ইমাম সাজ্জাদের ( আ) এ সব দুআয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইরফান ও মারেফাত ( আধ্যাত্মিক রূহানী জ্ঞান ) , স্রষ্টাতত্ত্ব , উচ্চাঙ্গের নীতি নৈতিকতা ও চারিত্রিক গুণাবলী সংক্রান্ত শিক্ষা ( মাকারিমুল আখলাক) এবং যালিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং তাদের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে মহান আল্লাহর কাছে পানাহ নেয়া , নুবুওয়ত, ইমামত , ন্যায়পরায়ণতা, আখেরাত ইত্যাদি সংক্রান্ত খাঁটি ইসলামী আকিদা বিশ্বাস এবং সামাজিক বিষয়াদি তাঁর এ সব দুআ ও প্রার্থনায় বর্ণিত হয়েছে। আর সাহীফা – ই সাজ্জাদীয়াহ হচ্ছে ইমাম যাইনুল আবিদীনের ( আ ) অনবদ্য সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থনা ও দুআ সমূহের সমগ্র যা খাঁটি ইসলামী জ্ঞান ও বিজ্ঞান ও স্রষ্টাতত্ত্বের সর্বোৎকৃষ্ট উৎস
হওয়ার পাশাপাশি আরবী ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শনও বটে । আর এজন্য ৫ শা’বান ইরানে ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যাইনুল আবিদীনের ( আ) শুভ জন্মদিনকে রূযে সাহীফা – ই সাজ্জাদীয়াহ ( সাহীফা – ই সাজ্জাদীয়াহ দিবস ) ঘোষণা করা হয়েছে ।
৯ শা’বান : কোনো কোনো বর্ণনায় চতুর্থ ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যাইনুল আবিদীনের (আ) জন্মদিন।

১১ শা’বান: ইমাম হুসাইনের ( আ) জৈষ্ঠ্য পুত্র হযরত আলী আকবরের ( আ) শুভ জন্মদিন যিনি কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন । তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইনের কাছে অত্যন্ত প্রিয় । কারবালায় তাঁর শাহাদাতে ইমাম হুসাইন (আ) তীব্র শোক ও দু:খ ( হুযন) প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী বীর যুবক । ইরানে তাঁর শুভ জন্মদিনকে ( ১১ শাবান) রূযে জাভন্ ( যুবক দিবস ) ঘোষণা করা হয়েছে।

১৫ শাবান : মহানবীর ( সা ) পবিত্র আহলুল বাইতের (আ) বারো মাসূম ইমামের দ্বাদশ অর্থাৎ সর্বশেষ মাসূম ইমাম , সাহিবুয যামান (যুগের অধিপতি) , যুগের ইমাম (ইমাম – ই যামান ) , আল -হুজ্জাহ্ ( সৃষ্টি জগতের ওপর মহান আল্লাহর ঐশী প্রমাণ ও দলীল ) মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আল – মাহদীর ( আ ) শুভ জন্মদিন। তিনি প্রতিশ্রুত মাহ্দী ( মাহদী -ই মৌঊদ্ ) তিনি অন্তর্ধানে ( গাইবত) আছেন এবং মহান আল্লাহর অনুমতি ও ইচ্ছায় শেষ যামানায় ( কিয়ামতের পূর্বে) আবির্ভূত হয়ে সমগ্র বিশ্বকে ন্যায় , সুবিচার , ইনসাফ ও আদালত দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন ঠিক তেমন ভাবে যেমন ভাবে তা অন্যায়, অত্যাচার , অবিচার ও যুলম দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে । আর শেষ যামানায় সর্বশেষ ইমাম মাহদীর ( আ) আবির্ভাব ও আগমনের ব্যাপারে সকল মুসলিম উম্মাহ একমত । যেহেতু তাঁর আবির্ভাব ও যুহূরের মাধ্যমে বিশ্বের সকল নিপীড়িত নির্যাতিত মুস্তায’আফ্ জনতা সকল যুলুম , অন্যায় ও অত্যাচার থেকে নাজাত পাবে সেহেতু ইরানে এ দিবসের নাম করণ করা হয়েছে রূযে মুস্তায’আফীন্ ( বিশ্ব মুস্তায’আফ দিবস ) ।
আর ১৫ শাবানের রাত লাইলাতুল কদরের রাতের পর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। মহান আল্লাহ এ রাতে বান্দাদেরকে স্বীয় ফযল ( কৃপা ও অনুগ্রহ ) হতে দান করেন এবং তাদেরকে নিজের দয়া ও উদারতা দিয়ে ক্ষমা করে দেন । অতএব এ রাতে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে বান্দাগণ সবাই চেষ্টা করবে । এ রাতে মহান আল্লাহ স্বীয় পবিত্র সত্তার কসম দিয়ে ওয়াদা করেছেন যে যে কেউ তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে তাকে তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না যে পর্যন্ত না সে অবাধ্যতার সন্ধান করে ( পাপাচারে লিপ্ত হয় )। মহান আল্লাহ যেমন লাইলাতুল কদরকে ( কদরের রজনী ) মহানবীর (সাঃ) জন্য মনোনীত ও নির্ধারিত করেছেন ঠিক তেমনি এ রাতকেও (১৫ শাবানের রজনী ) মহানবীর (সাঃ) আহলুল বাইতের (আ) জন্য মনোনীত ও নির্ধারিত করেছেন। তাই এ রাতে সবার উচিত দুআ ও সানা ( মহান আল্লাহর গুণকীর্তন) করার ক্ষেত্রে (যথাসাধ্য ) চেষ্টা করা । এ রাতের এ সব ফযীলত ও মর্তবা ইমাম জা’ফার সাদিক্ব ( আ) ইমাম বাক্বির ( আ) থেকে বর্ণনা করেছেন (মাফাতীহুল জিনান দ্রষ্টব্য ) । এ রাতের বরকত সমূহের অন্তর্ভুক্ত সর্বশ্রেষ্ঠ বরকত হচ্ছে এই যে ২৫৫ হিজরী সালের এ রাতের ( ১৫ শাবান ) সাহারের সময় ( সুবহে সাদিক অর্থাৎ ফজরের ওয়াক্তের কাছাকাছি সময় ) ইরাকের সামাররা নগরীতে হযরত সুলতান – ই আসর ইমাম – ই যামান মাহদী ( আ) জন্মগ্রহণ ( বেলাদত ) করেন । তাঁর শুভ জন্মগ্রহণের কথা আহলে সুন্নাতের বেশ কিছু আলেম , মনীষী , ইতিহাস রচয়িতা এবং নসবনামাবিদ নিজেদের গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম মাহদীর ( আ) পিতা মহানবীর (সাঃ) আহলুল বাইতের (আ) একাদশ মাসূম ইমাম হযরত হাসান ইবনে আলী আল – আসকারী ( আ )। একাদশ মাসুম ইমাম শাহাদাত বরণ করলে দ্বাদশ ইমাম মাহদী ২৬০ হিজরী সালে গাইবত বা অন্তর্ধানে অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তাঁর অন্তর্ধান ( গাইবত ) দুই পর্যায়ের যথা: ১. সংক্ষিপ্ত ছোট অন্তর্ধান কাল বা গাইবত-ই সুগরা ( ২৬০ হিজরী থেকে ৩২৯ হিজরী সাল ) এবং ২. বৃহৎ অন্তর্ধান কাল বা গাইবত – ই কুবরা যা ৩২৯ হিজরী থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং মহান আল্লাহ যখন ইচ্ছা করবেন কিয়ামতের পূর্বে আখেরী যামানায় ( শেষ যুগে) তিনি ( ইমাম মাহদী) অন্তর্ধান ( গাইবত : লোকচক্ষুর অন্তরাল ) থেকে আবির্ভূত হবেন এবং বিশ্বব্যাপী ন্যায় ও সত্যের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন এবং কিয়ামতের পূর্বে অর্থাৎ আখেরী যামানায় বারো মাসূম ইমামের সর্বশেষ ইমাম অর্থাৎ দ্বাদশ মাসূম ইমাম হযরত মাহদীর ( আ ) আগমন এবং বিশ্বব্যাপী তিনি যে সত্য ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন সে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য ( ইত্তিফাক) বিদ্যমান যা ইজমা হতেও উচ্চতর ।
এ রাতের বেশ কিছু বিশেষ আমল দুআর কিতাবাদিতে ( যেমন: মাফাতীহুল জিনান) বর্ণিত হয়েছে।
পহেলা শাবান থেকে ১৫ শাবান – এই প্রথম পক্ষকাল ( ১৫ দিন ) আ’ইয়াদ – ই শা’বানীয়াহ ( শাবান মাসের ঈদ ও উৎসব সমূহ ) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শাবান মাস এমন এক মাস যে মাসে মহানবীর (সাঃ) পবিত্র আহলুল বাইতের (আ) কেউ শাহাদাত বরণ করেন নি । এ মাসে কোনো শাহাদাত দিবস নেই। আ’ইয়াদ- ই শা’বানীয়াহর উৎসবের চূড়ান্ত পর্যায় ও দিবস হচ্ছে জাশন ও ঈদে বেলাদত – ই সাহিবুয যামান হযরত মাহদী ( আ ) অর্থাৎ যুগের অধিপতি ইমাম মাহদীর ( আমাদের জীবন প্রাণ তাঁর জন্য উৎসর্গিত হোক ) শুভ জন্মোৎসব ।
(বিস্তারিত বিবরণের জন্য মাফাতীহুল জিনান দ্রষ্টব্য)
সংগ্রহ : ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান