‘আমার কাছে একটি কোরআন প্রেরণ করুন। এটাকে সমালোচনার দৃষ্টি থেকে দেখবেন না। আপনি যদি আমার কাছে গোপনে কিছু পাঠাতে পারেন, তবে হেগেলের রচনা পাঠাবেন। বিশেষত হেগেলের ‘হিস্টোরি অব ফিলোসফি’ পাঠাবেন।
ওপরের বাক্যগুলো রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির একটি চিঠি থেকে নেওয়া, যা তিনি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার এক সপ্তাহ পর ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪ তারিখে তাঁর ভাইয়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন। এর এক বছর পর তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘মেমোরিজ অব দ্য হাউস অব দ্য ডেড’ লেখেন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন সাইবেরিয়ার সেসব বন্দির উদ্দেশে, যাদের কথা এখনো লেখা হয়নি।
এই বইয়ে দস্তয়েভস্কি আলী নামে একজন মুসলিম তাতার বন্দির সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি লেখেন, ‘আমি একজন তরুণ টেরকেসকে (দস্যুতার অভিযোগে দণ্ডিত) রুশ ভাষা শেখাচ্ছিলাম। সে কতই না কৃতজ্ঞ ছিল!’
ধারণা করা হয়, আলীর সঙ্গে তাঁর এই সাক্ষাৎ দস্তয়েভস্কিকে ইসলামের সঙ্গে পরিচিত করেছিল। সম্ভবত ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে দস্তয়েভস্কি রুশ বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কোরআন পাঠ করেন। কেননা খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে রুশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় কোরআনের একাধিক অনুবাদ প্রকাশ পেয়েছিল।
দস্তয়েভস্কি ও এক মুসলিম তরুণের গল্পউল্লিখিত বইয়ে তিনি আরো লেখেন, ‘ককেশিয়ান পর্বতমালার একদল পর্বতারোহী—যাদের মধ্যে একজন চেচেন, দুজন লেজিয়ান এবং দাগেস্তানের তিনজন তাতার ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ ছিল। তারা জেল ব্যারাকের সীমানার দিকটাতে থাকত।’
দস্তয়েভস্কি চেচেন বন্দি নুররা ও তার গভীর ধর্মবিশ্বাস ও অনুরাগের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি লেখেন, ‘বন্দি হওয়ার পর থেকে সে কখনো কোনো চুরি করেনি, কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। মোহগ্রস্তের মতো ধর্মপালন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে প্রার্থনা করতেন।
মুসলিমদের উৎসবের আগে (ঈদুল ফিতর) রোজা রাখতেন। রাত জেগে প্রার্থনা করতেন। ধর্মপরিচয়ের পার্থক্য বন্দিদের ভেতর কখনো সংঘাতের কারণ হয়নি।’
দস্তয়েভস্কি নুররার সঙ্গীদের সহানুভূতি ও নিরাপত্তা দ্বারা উপকৃত ছিলেন। বিশেষত যারা দাগেস্তানের অধিবাসী ছিল। তিনি লেখেন, ‘দাগেস্তানের তিন তাতার ছিল পরস্পরের ভাই। তাদের দুজন ছিল মধ্যবয়সী। কিন্তু তৃতীয় ভাই আলীর বয়স ২২ বছরের বেশি ছিল না। তাকে দেখতে আরো ছোট মনে হতো।’
দস্তয়েভস্কি আলীকে রুশ ভাষা শেখাতেন এবং বিনিময়ে আলী তাঁকে ককেশাস অঞ্চলের দুটি প্রধান ধর্ম ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে ধারণা দেয়। উভয় ধর্মের চমৎকার মিলের জায়গাটা হলো ঈসা (আ.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
একদিন সন্ধ্যায় আমি বললাম, শোনো আলী! তুমি কেন রুশ ভাষা শিখছ না? এটা তোমার উপকারে আসতে পারে। আর কোথাও না হলেও এই সাইবেরিয়ায়। আলী বলল, আমি সেটা চাই, তবে কার কাছে শিখব? আমি বললাম, এখানে অনেক শিক্ষিত মানুষ আছে, তাদের কাছ থেকে। তুমি চাইলে আমিও তোমাকে শেখাতে পারি। আলী বলল, ঠিক আছে। চলুন শুরু করা যাক।
আলী এত দ্রুত রুশ ভাষা শিখে নিল যে দস্তয়েভস্কি আশ্চর্য হলেন। তরুণ এই তাতার মাত্র তিন মাসে রুশ ভাষা পড়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করল। কিন্তু পড়ার জন্য তারা পেলেন নিউ টেস্টামেন্টের একটি কপি, যা উভয়কে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। দস্তয়েভস্কি বলেন, আমি লক্ষ করলাম, সে কিছু অধ্যায় স্মরণে রেখেছে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই মাত্র তুমি যা পড়লে তা কি তুমি পছন্দ করো? সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল। এরপর বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন। তিনি তাঁর কথাই প্রচার করেছেন। তাঁর কথাগুলো সত্যিই সুন্দর। যেমন তিনি বলেছেন, ক্ষমা কোরো, ভালোবাসো, কষ্ট দিয়ো না, শত্রুকেও ভালোবাসো। আলী তাঁকে আরো জানিয়েছিলেন, ঈসা (আ.) সত্যিই আল্লাহর নবী ছিলেন। তিনি আল্লাহর হুকুমে কিছু আশ্চর্য কাজ করেছেন। যেগুলো তাদের কিতাব কোরআনে লেখা আছে।
আলী ও তার ভাইদের সাক্ষাৎ ফিওদর দস্তয়েভস্কির ভেতর মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল, যা তাঁর পরবর্তী রচনাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর রচনায় ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইতিবাচক আলোচনাও পাওয়া যায়।
নভে. 6 2023
রুশ সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কি যেভাবে কোরআন সম্পর্কে জেনেছিলেন
‘আমার কাছে একটি কোরআন প্রেরণ করুন। এটাকে সমালোচনার দৃষ্টি থেকে দেখবেন না। আপনি যদি আমার কাছে গোপনে কিছু পাঠাতে পারেন, তবে হেগেলের রচনা পাঠাবেন। বিশেষত হেগেলের ‘হিস্টোরি অব ফিলোসফি’ পাঠাবেন।
ওপরের বাক্যগুলো রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির একটি চিঠি থেকে নেওয়া, যা তিনি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার এক সপ্তাহ পর ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪ তারিখে তাঁর ভাইয়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন। এর এক বছর পর তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘মেমোরিজ অব দ্য হাউস অব দ্য ডেড’ লেখেন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন সাইবেরিয়ার সেসব বন্দির উদ্দেশে, যাদের কথা এখনো লেখা হয়নি।
এই বইয়ে দস্তয়েভস্কি আলী নামে একজন মুসলিম তাতার বন্দির সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি লেখেন, ‘আমি একজন তরুণ টেরকেসকে (দস্যুতার অভিযোগে দণ্ডিত) রুশ ভাষা শেখাচ্ছিলাম। সে কতই না কৃতজ্ঞ ছিল!’
ধারণা করা হয়, আলীর সঙ্গে তাঁর এই সাক্ষাৎ দস্তয়েভস্কিকে ইসলামের সঙ্গে পরিচিত করেছিল। সম্ভবত ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে দস্তয়েভস্কি রুশ বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কোরআন পাঠ করেন। কেননা খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে রুশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় কোরআনের একাধিক অনুবাদ প্রকাশ পেয়েছিল।
দস্তয়েভস্কি ও এক মুসলিম তরুণের গল্পউল্লিখিত বইয়ে তিনি আরো লেখেন, ‘ককেশিয়ান পর্বতমালার একদল পর্বতারোহী—যাদের মধ্যে একজন চেচেন, দুজন লেজিয়ান এবং দাগেস্তানের তিনজন তাতার ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ ছিল। তারা জেল ব্যারাকের সীমানার দিকটাতে থাকত।’
দস্তয়েভস্কি চেচেন বন্দি নুররা ও তার গভীর ধর্মবিশ্বাস ও অনুরাগের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি লেখেন, ‘বন্দি হওয়ার পর থেকে সে কখনো কোনো চুরি করেনি, কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। মোহগ্রস্তের মতো ধর্মপালন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে প্রার্থনা করতেন।
মুসলিমদের উৎসবের আগে (ঈদুল ফিতর) রোজা রাখতেন। রাত জেগে প্রার্থনা করতেন। ধর্মপরিচয়ের পার্থক্য বন্দিদের ভেতর কখনো সংঘাতের কারণ হয়নি।’
দস্তয়েভস্কি নুররার সঙ্গীদের সহানুভূতি ও নিরাপত্তা দ্বারা উপকৃত ছিলেন। বিশেষত যারা দাগেস্তানের অধিবাসী ছিল। তিনি লেখেন, ‘দাগেস্তানের তিন তাতার ছিল পরস্পরের ভাই। তাদের দুজন ছিল মধ্যবয়সী। কিন্তু তৃতীয় ভাই আলীর বয়স ২২ বছরের বেশি ছিল না। তাকে দেখতে আরো ছোট মনে হতো।’
দস্তয়েভস্কি আলীকে রুশ ভাষা শেখাতেন এবং বিনিময়ে আলী তাঁকে ককেশাস অঞ্চলের দুটি প্রধান ধর্ম ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে ধারণা দেয়। উভয় ধর্মের চমৎকার মিলের জায়গাটা হলো ঈসা (আ.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
একদিন সন্ধ্যায় আমি বললাম, শোনো আলী! তুমি কেন রুশ ভাষা শিখছ না? এটা তোমার উপকারে আসতে পারে। আর কোথাও না হলেও এই সাইবেরিয়ায়। আলী বলল, আমি সেটা চাই, তবে কার কাছে শিখব? আমি বললাম, এখানে অনেক শিক্ষিত মানুষ আছে, তাদের কাছ থেকে। তুমি চাইলে আমিও তোমাকে শেখাতে পারি। আলী বলল, ঠিক আছে। চলুন শুরু করা যাক।
আলী এত দ্রুত রুশ ভাষা শিখে নিল যে দস্তয়েভস্কি আশ্চর্য হলেন। তরুণ এই তাতার মাত্র তিন মাসে রুশ ভাষা পড়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করল। কিন্তু পড়ার জন্য তারা পেলেন নিউ টেস্টামেন্টের একটি কপি, যা উভয়কে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। দস্তয়েভস্কি বলেন, আমি লক্ষ করলাম, সে কিছু অধ্যায় স্মরণে রেখেছে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই মাত্র তুমি যা পড়লে তা কি তুমি পছন্দ করো? সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল। এরপর বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন। তিনি তাঁর কথাই প্রচার করেছেন। তাঁর কথাগুলো সত্যিই সুন্দর। যেমন তিনি বলেছেন, ক্ষমা কোরো, ভালোবাসো, কষ্ট দিয়ো না, শত্রুকেও ভালোবাসো। আলী তাঁকে আরো জানিয়েছিলেন, ঈসা (আ.) সত্যিই আল্লাহর নবী ছিলেন। তিনি আল্লাহর হুকুমে কিছু আশ্চর্য কাজ করেছেন। যেগুলো তাদের কিতাব কোরআনে লেখা আছে।
আলী ও তার ভাইদের সাক্ষাৎ ফিওদর দস্তয়েভস্কির ভেতর মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল, যা তাঁর পরবর্তী রচনাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর রচনায় ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইতিবাচক আলোচনাও পাওয়া যায়।
By bn • প্রকাশনা কেন্দ্র 0 • Tags: আলী, চিঠি, তরুণ, ভাষা, রুশ, সাইবেরিয়ার