নিজ হাতে নিজের প্রতিনিধিকে প্রস্তুত করেছেন বিশ্বনবী (সা.)

নিজ হাতে নিজের প্রতিনিধিকে প্রস্তুত করেছেন বিশ্বনবী (সা.)
নিজ হাতে নিজের প্রতিনিধিকে প্রস্তুত করেছেন বিশ্বনবী (সা.)

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে, আলী (আ.) ছিলেন যুবকদের জন্য বীরত্ব ও সাহসিকতার আদর্শ, সরকার-প্রধানদের জন্য ন্যায়বিচারের আদর্শ, ইবাদত, খোদাপ্রেম ও ভারসাম্যপূর্ণ অনাড়ম্বর জীবনের জন্য সব মুমিন মুসলমানের জন্যই আদর্শ। তাঁর মুক্তিকামীতা বিশ্বের সব মুক্তিকামীর আদর্শ এবং প্রজ্ঞাময় বক্তব্য ও চিরস্মরণীয় উপদেশগুলো আলেম, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের জন্য আদর্শ।
আলী (আ.) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব নদী-দখলকারী শত্রুরা যার বাহিনীর জন্য নদীর পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে সেই শত্রুদের পরাজিত করার পরও তিনি ওই নদীর পানি কোনো শত্রুর জন্য নিষিদ্ধ করেননি। জালিমদের বিরুদ্ধে আলী (আ.) সবচেয়ে কঠোর হলেও তিনি ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ওপর আঘাত হানতেন।
সিফফিনের যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয়পক্ষের লোকক্ষয় এড়ানো ও বিদ্রোহীদের সুপথে আনার জন্য তিনি এত বেশী অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে, সে সময় শত্রুরা এ প্রচারণা চালিয়েছিল যে মহাবীর আলী (আ.) মৃত্যুকে ভয় পান! অথচ শাহাদত ছিল তাঁর কাছে এতটা প্রিয় যতটা প্রিয় শিশুর কাছে মাতৃস্তন। তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সা.) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন। আলী (আ.) সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ও ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। সত্যের পথে অবিচল থাকলে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও নেতা তাঁকে ত্যাগ করবেন বলে তিনি জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়-বিচারের পথ ত্যাগ করেননি। ফলে শাহাদতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন হযরত আলী (আ.)। মোয়াবিয়া যখন বায়তুল মালের সম্পদ অবাধে ব্যবহার করে নিজের পক্ষে সুযোগ সন্ধানী লোকদের টেনে দল ভারী করতো, তখন মোয়াবিয়ার বিদ্রোহের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও হযরত আলী (আঃ) তাঁর গভর্নরদের মাধ্যমে ব্যবহৃত বায়তুল মালের সম্পদের প্রতিটি পয়সার হিসেব নিতেন।
একদল সরলমনা ও ধর্মান্ধ ব্যক্তি দুনিয়াপুজারী ও ক্ষমতালোভীদের প্রতারণার শিকার হয়ে হযরত আলী (আঃ)’র মতো নিষ্পাপ মুমিনকেও কাফের বলে ঘোষণা দেয়! ইতিহাসে এই শ্রেণী খারেজী বলে খ্যাত। এই খারেজীদেরই অন্ধ অনুসারী ইবনে মুলজেম আল আশআসসহ আলী (আঃ)’র চরম বিদ্বেষী কয়েক ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে শরীক হয়। ইবনে মুলজেম ১৯ শে রমজানের ফজরের নামাজের সময় সিজদারত অবস্থায় হযরত আলী (আঃ)’র শির মোবারকে বিষাক্ত তরবারির আঘাত হানে। এ আঘাতে আহত আমীরুল মুমিনীন ২১শে রমজানের রাতে শাহাদত বরণ করেন এবং শেষ হয়ে যায় চার বছর ও নয় মাসের খেলাফত । তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩। শাহাদতের কিছুক্ষণ আগে বড় ছেলে হযরত হাসান মুজতাবাকে কাঁদতে দেখে মুমিনদের মাওলা হযরত আলী (আঃ) বলেন, হে আমার সন্তান কেঁদো না, এখন রাসূলে খোদা (সাঃ), তোমার মা হযরত ফাতিমা ও ফেরেশতারা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন এবং তাঁরা আমাকে স্বাগতঃ জানাচ্ছেন।
হযরত আলী (আঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (আঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ” আমি জ্ঞানের নগরী, আলী তার দরজা, যে কেউ আমার জ্ঞানের মহানগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে”।
মহানবী (সাঃ) আরো বলেছেন:
হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর, কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না।
বিশ্বনবী (সাঃ) আরো বলেছেন:
* আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়।
* হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না।
অনেক সাহাবী এ হাদিসের ভিত্তিতেই মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন।
রাসূলে পাক (সাঃ)’র স্ত্রী বিবি আয়শা হযরত আলী (আঃ)’র শাহাদতের খবর শুনে বলেছিলেন,
“হে রাসূল! তোমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন। আজ এমন এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ)’র পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।
” আর এইসব বাণী থেকে এটা স্পষ্ট যে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র পর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব।
হযরত আলী (আ.)’র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্বে অমুসলিম পণ্ডিতরাও অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (আ.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ‍ব্যক্তি।
ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, “সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (আ.)’র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রীক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।”
ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)’র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (আ.)।
শাহাদত-প্রেমিক আলী(আ.) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তাঁর সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সবাই কাঁদছে, চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ, কিন্তু আলী (আ.)-এর মুখ হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন,
“আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?”
ঘাতকের প্রাণঘাতী আঘাতে ধরাশায়ী আমিরুল মু’মিনিন এ ঘটনা নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা অবিচার না করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,
“আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা তোমরা এমন যেন না কর, যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা করবে এ অজুহাতে যে, আমীরুল মু’মিনীনকে শহীদ করা হয়েছে। অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল, অমুক এ কাজে উৎসাহিত করেছে। এসব কথা বলে বেড়াবে না, বরং আমার হত্যাকারী হল এই ব্যক্তি।”
আলী (আ.) ইমাম হাসান (আ.)-কে বলেছিলেন,
“বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে তাহলে মুক্তি দিও, যদি চাও কিসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে, সে তোমার পিতাকে একটি আঘাত করেছে, তাকেও একটি আঘাত করবে। যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো করল, নতুবা ছেড়ে দেবে।”
তারপর আবার বন্দির চিন্তায় মগ্ন হলেন আলী (আ.)। বন্দিকে ঠিক মতো খেতে দিয়েছ তো? পানি দিয়েছ খেতে? ঠিক মতো দেখাশোনা কর ওর। কিছু দুধ তাঁর জন্য আনা হলে কিছুটা খেয়ে বললেন, বাকীটা বন্দিকে দাও।
হযরত আলী (আঃ) নিজেকে সব সময় জনগণের সেবক বলে মনে করতেন এবং সব সময় অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী ইবনে আবি তালিবের মতো আরেকজনকে জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নারীকূলের কারো নেই, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।
এখন চলছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাস হল মানুষের ভোগ-প্রবণতাকে প্রবল ইচ্ছা-শক্তি ও বিবেক দিয়ে সংযত করার মাস। এক্ষেত্রেও আলী (আ.) ছিলেন মহাবীর ও সবার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
• হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ ছিল যা অন্য কারো ছিল না। আরব ও অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে সালাত আদায় করেছেন। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝান্ডা থাকতো। তৃতীয়তঃ লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো। চতুর্থতঃ আলীই রাসূল (সাঃ)কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে শায়িত করেছিলেন।
জীরার ইবনে হামজা তাঁর প্রিয় নেতার গুণাবলী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, “আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দণ্ড, তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়ভিত্তিক, সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশিত হত। তিনি মোটা বা সাদামাটা খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অল্প দামের পোশাক পছন্দ করতেন। আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের একজন হিসেবে আমাদের মাঝে ছিলেন, আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আমাদের সকল অনুরোধ রক্ষা করতেন। তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সম্বোধন করে কিছু বলতে ও প্রথমে কথা বলতে আমরা ভয় পেতাম না। তাঁর হাসিতে মুক্তা ছড়িয়ে পড়তো। তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন। অভাবগ্রস্তের প্রতি খুবই দয়ালু ছিলেন। এতিম, নিকট আত্মীয় ও অন্নহীনকে খাওয়াতেন। তিনি বস্ত্রহীনে বস্ত্র দিতেন ও অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করতেন। তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন । আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার এ অবস্থায় মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না!” .. .. .. এরপর জীরার বলেন, আলী (আঃ)’র অনুপস্থিতিতে আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে।
এবারে হযরত আলী (আঃ)’র প্রবাদতুল্য কয়েকটি বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা:
*বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।
*সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।
* আমি তাদের সম্পর্কে বিস্মিত হই যারা কিছু হারিয়ে ফেললে তা ফিরে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, অথচ নিজ আত্মাকে হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে তাদের মধ্যে সচেতনতা নেই।