ইমাম জাফর সাদেক (আ)’র ১১টি নৈতিক ও সামাজিক উপদেশ

ইমাম জাফর সাদেক (আ)'র ১১টি নৈতিক ও সামাজিক উপদেশ
ইমাম জাফর সাদেক (আ)’র ১১টি নৈতিক ও সামাজিক উপদেশ

পবিত্র আহলে বাইতগণের ইমামদের মধ্যে অন্যতম ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জনগণের কাজের দায়িত্ব নেবে, ন্যায়বিচার করবে, মানুষের জন্য তার ঘরের দরজা খুলে দেবে, মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না এবং মানুষের বিষয় দেখাশোনা করবে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহার প্রশংসা যিনি তাকে কেয়ামতের দিন ভয় ও আতঙ্ক থেকে রক্ষা করবেন তার জন্য বেহেশত নসিব করবেন।

জাফর বিন মুহাম্মদ ইমাম জাফর সাদিক (আ.) নামে পরিচিত (৮৩-১৪৮ হিজরি)। তাঁর পিতা ইমাম বাকের (আ.)-এর পর তিনি শিয়া মুসলমানদের ১২ ইমামদের মধ্যে ষষ্ঠ ইমাম। তিনি ১১৪ হিজরি থেকে ১৪৮ হিজরি অর্থ্যাৎ ৩৪ বছর পর্যন্ত শিয়া মুসলমানদের ইমামতের দায়িত্বে ছিলেন।

ইমাম জাফর সাদেক (আ) হিশাম বিন আব্দুল মালিক থেকে পরবর্তী পাঁচ উমাইয়া খলিফার রাজত্ব এবং প্রথম দুই আব্বাসীয় খলিফা সাফাহ এবং মনসুর দাওয়ানিকির শাসনামলে মুসলমানদের ইমাদের দায়িত্ব পালন করেন। উমাইয়া সরকারের নানা প্রতিকূলতা এবং দুর্বলতার কারণে ইমাম সাদেক (আ.) সেসময় অন্যান্য শিয়া ইমামদের তুলনায় অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর ছাত্র ও বর্ণনাকারীর সংখ্যা চার হাজার। আহলে বাইত ইমাম (আ)’র অধিকাংশ হাদিস ইমাম সাদিক (আ.)র কাছ থেকে এসেছে এবং এই কারণেই ইমামিয়া শিয়া মাজহাবকে জাফরি মাজহাবও বলা হয়।

ইমাম জাফর সাদেক (আ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ফিকাহশাস্ত্রবিদদের নিকট উচ্চ মর্যাদার আসনে ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক ইবনে আনাস তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আবু হানিফা তাকে মুসলমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা নুমান বিন সাবেত বলেন: আমি ইমাম জাফর বিন মুহাম্মাদের চেয়ে বড় ফকিহ আর দেখিনি। আমি একদিন খলিফা মানসুরের নির্দেশে ফিকাহ শাস্ত্রের ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খলিফার দরবারে উপস্থিত আলেমদের সামনে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করি। দরবারে উপস্থিত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ৪০টি প্রশ্নেরই এত সুন্দর ও চমৎকার উত্তর দেন যে, উপস্থিত প্রত্যেকে একবাক্যে স্বীকার করেন ইসলামি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিক দিয়ে তিনি সব আলেমের চেয়ে অগ্রগামী।

ইমাম সাদেক (আ)’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “আমরা নবীর আহলে বাইত সেই পরিবার যাদের পৌরুষত্ব হল তাকে ক্ষমা করা যে আমাদের উপর অন্যায় করেছে।”

শেখ সাদুক স্পষ্ট করেছেন যে, ইমাম সাদেক (আ.) মনসুর দাওয়ানিকির নির্দেশে বিষ প্রয়োগের ফলে শহীদ হয়েছেন।

আজকের নিবন্ধে আমরা এই মহান ইমামের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে তার ১১টি নৈতিক ও সামাজিক সুপারিশ দেখব:

১, নিজের দোষ নিয়ে ব্যস্ত থাকুন

ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, লোকের দোষ-ত্রুটিকে প্রভুর মতো দেখো না, আর চাকরের মতো নিজের দোষ দেখো না। (তাহফুল উকুল/ ২৯৫)

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন: অন্যের দোষ-ত্রুটিকে প্রভুর মতো দেখো না, বরং নম্র চাকর হিসেবে নিজের দোষ-ত্রুটি পরীক্ষা কর।

২. মিথ্যা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দূরে থাকুন

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: তিনটি বৈশিষ্ট্য মুনাফিকির লক্ষণ, যদিও সে সালাত ও রোজাদার ব্যক্তি হয়: মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা। (তাহফুল উকুল/২২৯)

৩. হয় পণ্ডিত হও বা ছাত্র হও

ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, “আমি তোমাদের মধ্যে কোন যুবককে দেখতে পছন্দ করি না যদি না এই অবস্থার একটিতে থাকে: হয় একজন আলেম বা একজন ছাত্র।” (আমালী শেখ তুসী/৩০৩ ও ৬০৪)

৪. সর্বদা উদার ও সদালাপী হন

ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, “সব সময় উদারতা ও ভালো ব্যবহারের উপর অটল থাকো, কারণ এগুলো মানুষকে এমনভাবে শোভিত করে যেভাবে একটি নেকলেসের ভেতর একটি বড় মুক্ত তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। ( মিজানুল হিকাম/৩০০, বিহার-উল- আনওয়ার/৩৯১)

৫. সর্বদা ন্যায়পরায়ন হন এবং মানুষের সমস্যার সমাধান করুন

যে ব্যক্তি জনগণের কাজের দায়িত্ব নেবে, ন্যায়বিচার করবে, মানুষের জন্য তার ঘরের দরজা খুলে দেবে, মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না এবং মানুষের বিষয় দেখাশোনা করবে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহার প্রশংসা যিনি তাকে কেয়ামতের দিন ভয় ও আতঙ্ক থেকে রক্ষা করবেন তার জন্য বেহেশত নসিব করবেন। (মিজানুল হিকাম/৭১২২, বিহার-উল- আনওয়ার /ভলিউম-৭৫, পৃ-৪৩০)

৬. প্রার্থনায় বিরক্ত হবেন না

সাইফ তাম্মার ইমাম সাদেক (আ.) থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ” সব সময় দোয়াতে লেগে থাকুন কারণ এর মতো অন্য কোন জিনিস দিয়ে আপনি আল্লাহর নৈকট্য পাবেন না; ক্ষুদ্রতার কারণে একটি ছোট প্রয়োজনের দাবি করা ছেড়ে দেবেন না কারণ যিনি ছোট প্রয়োজনের মালিক প্রকৃতপক্ষে তিনি বড় চাহিদার মালিকও।” (আমালী শেখ মফিদ, মজলিস 2, পৃ. 31

৭. মানুষের সাথে সদয়ভাবে করমর্দন করুন

ইমাম সাদেক (সা.) বলেন, “আল্লাহর রাসূল (সা) কখনই কোন ব্যক্তির সঙ্গে তার হাত ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য করমর্দন করেননি যদি না সেই ব্যক্তিই প্রথম তার হাত ফিরিয়ে নেয়।” (বিহার-উল আনোয়ার, v১৬, p২৬৯)

৮. মজা করুন তবে কেবল সত্য বলুন

ইমাম সাদেক (সা.) বলেন, “আল্লাহর রসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ) রসিকতা করতেন কিন্তু সত্য ছাড়া কিছুই বলতেন না।” (বিহার-উল আনোয়ার, v১৬, পৃ-২৪৪)

৯. এমনভাবে কথা বলুন যাতে মানুষ বুঝতে পারে

ইমাম সাদেক (সা.) বলেন, “আল্লাহর রসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ) কখনই মানুষের সাথে তাদের বুদ্ধিমত্তার স্তরে কথা বলতেন না। আল্লাহর রসূল বলেছেন, ‘আমরা, নবীদের দল, মানুষের সঙ্গে তাদের বুদ্ধিমত্তার স্তরে কথা বলার জন্য আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে। (সোনান আল-নবী, পৃঃ৫৭)

১০. সর্বদা সুগন্ধযুক্ত হন

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন, “আল্লাহর রসূল (তাঁর উপর এবং তাঁর বংশধরদের ওপর সালাম বর্ষিত হোক) খাবারের চেয়ে সুগন্ধির জন্য বেশি ব্যয় করতেন।” (বিহার-উল আনোয়ার, ভলিউম১৬, পৃ-২৪৮)

১১. সাধারণ জীবনযাপন করুন তবে অতিথিদের শ্রদ্ধা করুন

ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, “বিশ্বাসীদের নেতা আমিরুল মোমেনিন ইমাম আলী (আ.) ছিলেন আল্লাহর রাসূল (তাঁর এবং তাঁর বংশধরদের উপর আল্লাহ রহমত বর্ষিত হোক)’র এর সঙ্গে সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি রুটি, ভিনেগার এবং জয়তুন তেল খেতেন। তবে তিনি মানুষকে রুটি ও মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।” (আল-কাফী, ভলিউম-৬, পৃ-৩২৮)