এ প্রবন্ধে আমরা পবিত্র কোরআন, রাসূল (সা.) এবং মাসুম ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েতের আলোকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দু’টি নামায এক সাথে আদায় প্রসঙ্গে তথ্য-সমৃদ্ধ আলাচনা ও পর্যালোচনা করব :
দু’টি নামায এক সাথে আদায় প্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ
সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ও প্রথম শ্রেণীর হাদীস গ্রন্থাবলী যেমন: সহীহ মুসলিম, সহীহ বোখারী, সহীহ তিরমিযী, মুয়াত্তা, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে নাসায়ী এবং মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক প্রভৃতিতে দু’টি নামায একত্রে আদায় তথা যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায অনিবার্য কোন কারণ (যেমন: সফরে থাকা, বৃষ্টি, ভয় কিংবা অনিষ্টের সম্ভাবনা) ছাড়াই একত্রে আদায় সম্পর্কে ত্রিশটির চেয়েও অধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলো মূলত: পাঁচজন প্রথম সারির রা’বীদের থেকে বর্ণিত, যথা:
১-হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)
২-হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.)
৩-হযরত আবু আইয়ুব (রা.)
৪-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং
৫-হযরত আবু হুরাইরা।
আমরা সম্মানিত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উক্ত রেওয়ায়েতগুলোর কিয়দাংশ এখানে তুলে ধরছি-
এক- আবুজ্ জুবাইর; সাঈদ ইবনে জুবাইর এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন,
صلّی رسول الله (ص) الظهر و العصر جمیعاً بالمدینة فی غیر خوف و لا سفر.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় অবস্থানকালীন সময়ে কোনরূপ ভীত ও সফরের কারণ ছাড়াই যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করেছেন।”
আবুজ্ জুবাইর বলেন যে, আমি সা’দ বিন জুবাইরের নিকট প্রশ্ন করলাম: কেন রাসূল (সা.) এমনটি করলেন?
জবাবে তিনি বলেন: আমিও অনুরূপ প্রশ্নটি ইবনে আব্বাসের নিকট জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরে তিনি বলেছেন,
أراد أن لا یحرج أحدا من أمّته.
“রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য ছিল যে, তার উম্মতের মধ্যে কেউ যেন বাড়তি চাপের শিকার না হয়।”১
দুই- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে,
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء فی المدینة فی غیر خوف و لا مطر.
“মহানবী (সা.) মদীনাতে কোনরূপ ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছাড়াই যোহর-আসর এবং মাগরিব ও এশার নামায একত্রে আদায় করতেন।”
হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়: এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য কি ছিল?
জবাবে তিনি বলেন: রাসূল (সা.) চেয়েছিলেন যে, কোন মুসলমান যেন নামায আদায়ের ক্ষেত্রে কষ্টের শিকার না হয়।২
তিন- আব্দুল্লাহ বিন শাকিক বলেন,
خطبنا ابن عبّاس یوما بعد العصر حتّی غربت الشمس و بدت النجوم و جعل الناس یقولون الصلاة الصلاة! قال فجائه رجل من بنی تمیم لا یفتر و لا یتنی :الصلاة،الصلاة فقال :ابن عبّاس أتعملنی بالسنّة ،لا أمّ لک ثمّ قال: رأیت رسول الله (ص) جمع بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء قال عبد الله بن شقیق :فحاک فی صدری من ذلک شیء فأتیت اباهریرة فسألته، فصدّق مقالته.
“একদা ইবনে আব্বাস আসরের নামায়ের পর আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় সূর্য অস্তমিত হয় এবং আকাশে নক্ষত্র পরিদৃষ্ট হয়। উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ‘নামায’ ‘নামায’ বলে আওয়াজ তুলেন। অতঃপর বনী তামিম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি সামনে এসে একাধারে ‘নামায’ ‘নামায’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন ইবনে আব্বাস বলেন: হে অজ্ঞ! তুমি কী আমাকে রাসূলের (সা.) সুন্নাতের শিক্ষা দিতে চাও? রাসূল (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক বলেন: আমার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এ কারণে আমি আবু হুরাইরার নিকট এসে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি ইবনে আব্বাসের কথার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।”৩
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و بین المغرب و العشاء بالمدینة من غیر خوف و لا مطر قال: فقیل لابن عبّاس :ما أراد بذلک؟ قال: أراد أن لا یحرج أمّته.
“মহানবী (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। অথচ তখন কোন ধরনের ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছিল না। ইবনে আব্বাসের নিকট জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য কি ছিল?
জবাবে তিনি বলেন: তিনি চেয়েছিলেন যে, তার উম্মত যেন কোনরূপ কষ্টের শিকার না হয়।”৫
ছয়- আহমাদ ইবনে হাম্বালও স্বীয় হাদীস গ্রন্থে অনুরূপ একটি হাদীস হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন।৬
সাত- সুন্নী মাযহাবের অন্যতম মনীষী ইমাম মালেক (রহ.) স্বীয় ‘আল মুয়াত্তা’ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন,
صلّی رسول الله (ص) الظهر و العصر جمیعا و المغرب و العشاء جمیعا فی غیر خوف و لا سفر.
“রাসূল (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। অথচ তখন কোনরূপ ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছিল না।”৭
আট- মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হতে বর্ণিত,
جمع لنا رسول الله (ص) مقیما غیر مسافر بین الظهر و العصر و المغرب فقال رجل لابن عمر: لم تری النبی (ص) فعل ذلک؟ قال لأن لا یحرج أمّته ان جمع رجل.
“মহানবী (সা.) সফর অবস্থাতে না থাকা সত্ত্বেও যোহর ও আসরের নামাযদ্বয় একত্রে আদায় করেন। কেউ ইবনে উমরের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন: কেন রাসূল (সা.) এমনটি করলেন? জবাবে তিনি বলেন: এমনটি করার কারণ হচ্ছে যদি কেউ এ দু’টি নামায একত্রে আদায় করে, তাহলে যেন তার উম্মতের কোন ব্যক্তি কষ্টের সম্মুখীন না হয় (কেউ যেন এক্ষেত্রে আপত্তি না করে)।”৮
নয়- জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত:
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء فی المدینة للرخص من غیر خوف و لا علّة.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনাতে যোহর-আসরের এবং মাগরিব এশার নামায একত্রে আদায় করেন, যাতে তার উম্মত এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। যদিও সেক্ষেত্রে কোন ধরনের সমস্যা কিংবা ভয়-ভীতির আশংকা না থাকে।”৯
দশ- আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত,
جمع رسول الله (ص) بین الصلوتین فی المدینة من غیر خوف.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় কোন ধরনের ভয় কিংবা অনিষ্টের আশংকা (শত্রুদের পক্ষ হতে) না থাকা সত্ত্বেও দু’টি নামায একত্রে আদায় করেছেন।”১০
এগার- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত,
جمع رسول الله (ص) بین الأولی و العصر و المغرب و العشاء فقیل له فقال: صنعته لئلّا تکون أمّتی فی حرج.
“রাসূল (সা.) মদীনায় যোহর-আসরের এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেন। সাহাবীদের মধ্যে একজন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন: আমি এ কাজটি এজন্য করেছি যে, আমার উম্মতের লোকেরা যেন কষ্টের শিকার না হয়।”১১
এখানে দু’টি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যথা:
১- উপরোক্ত হাদীসসমূহের সারাংশ
উপরোক্ত হাদীসসমূহ সুন্নী মাযহাবের সবচেয়ে পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থাবলী হতে উদ্ধৃত। আর এগুলোর সনদও প্রথম শ্রেণীর সাহাবীদের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে দু’টি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; যথা:
প্রথমত: মহানবী (সা.) অনিবার্য কোন কারণ যেমন: সফর, বৃষ্টি এবং শত্রুর ভয়-ভীতির কোন আশংকা ছাড়াই দু’টি নামায (যোহর-আসরের এবং মাগরিব এশার নামায) একত্রে আদায় করেছেন।
দ্বিতীয়ত: তাঁর এ কাজের উদ্দেশ্য ছিল উম্মতের কষ্ট লাঘব এবং প্রশস্ত সুযোগ রাখা। এমতাবস্থায় এটা কী আদৌ সমীচীন যে, এক শ্রেণীর লোকেরা এ ক্ষেত্রে নানাবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করবে এবং এটা প্রচার করবে যে, শুধুমাত্র অনিবার্য কারণবশতঃ দু’টি নামায একত্রে আদায় করা যাবে?
কেন আমরা বাস্তবতা হতে চোখ ফিরিয়ে নিব এবং রাসূলের (সা.) সুস্পষ্ট সুন্নতের পরিপন্থী আকিদার উপর গুরুত্বারোপ করব?
স্বয়ং আল্লাহ ও রাসূল (সা.) যে সুযোগ মানুষকে দিয়েছেন; কেন একশ্রেণীর গোঁড়ামি মানসিকতার ব্যক্তিরা সে সুযোগের যথোচিত ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে?
তারা কেন চায় না মুসলিম যুবকরা সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে, অফিস-আদালতে এবং কল-কারখানায় শরিয়াতের প্রদত্ত সুবিধাজনক পন্থায় প্রতিদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল তথা দৈনন্দিন নামায আদায় করুক?
আমরা বিশ্বাস করি যে, পবিত্র ইসলাম ধর্মেও বিধি-বিধান কিয়ামত অবধি বিশ্বের সর্বত্র ও সর্বকালের জন্য বহাল রয়েছে।
নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) তার নজিরবিহীন দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আজীবন অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর তাই তো তিনি এটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, সবাইকে যদি দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নামায আদায় বাধ্যগত করা হয়, তাহলে একদল মুসলমান নামায পরিত্যাগ করবে (যেমনটি বর্তমানে ঘটেছে)। এ কারণেই তিনি স্বীয় উম্মতের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন এবং মোক্ষম সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যাতে মুসলমানরা যে যেখানেই ব্যস্ত থাকুক না কেন দৈনন্দিন নামাযসমূহ যেন সহজেই আদায় করতে পারে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
“ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখা হয় নি।”১২
২- কোরআন এবং নামাযের তিনটি বিশেষ সময়
আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে পবিত্র কোরআনের দু’টি আয়াতে নামাযের সময় সূচীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে দিবারাত্রের নামাযসমূহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তথাপি সুন্নী মাযহাবের ভাইয়েরা কেন দৈনন্দিন নামাযসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করাকে ওয়াজিব মনে করেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
অবশ্য এ নামাযসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব ও উত্তম হওয়ার বিষয়টি অনস্বীকার্য। আমরাও যদি সময় ও সুযোগ অনুকূলে থাকে তবে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের আপত্তি হচ্ছে এটাকে ওয়াজিব মনে করার ক্ষেত্রে।
নামাযের সময় সূচী সম্পর্কে বর্ণিত প্রথম আয়াতটি সূরা হুদের অন্তর্ভুক্ত এখানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে,
“আর নামায আদায় করবে দিনের দুই প্রান্তে এবং রাত্রের প্রান্তভাগে।”১৩
এখানে طرف النهار দিনের দু’প্রান্তে বলতে ফজরের সময় (যে সময়টি হচ্ছে দিনের সূচনালগ্ন) এবং যোহর ও আসরের সময়কে (যা দ্বিপ্রহর থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত) বুঝানো হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, এ আয়াতের মাধ্যমে যোহর ও আসরের নামাযের সময়সীমা সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
পাশাপাশি উক্ত আয়াতে زلفا من اللیل শব্দাবলীর মধ্যে زلف হচ্ছে زلفه এর বহুবচন। বিশিষ্ট আভিধানিক রাগেব ইসফাহানী বলেছেন যে, এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাত্রের প্রথমাংশ; যা মাগরিব ও এশার নামাযের সময়ের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
সুতরাং রাসূল (সা.) বেশির ভাগই দৈনন্দিন পাঁচটি সময়ে নামায আদায় করেছেন এ কারণে যে, তা হচ্ছে মুস্তাহাব ও উত্তম; যে বিষয়টি আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু তাই বলে পবিত্র কোরআনের বাহ্যিক ঘোষণাকে উপেক্ষা করে অন্যরূপ ব্যাখ্যার পেছনে ছোটার কোন প্রয়োজন নেই।
অপর আয়াতটি পবিত্র কোরআনের সূরা বনী ইসরাইল বর্ণিত হয়েছে,
“অপরাহ্ন বা সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম কর এবং ফজরের কোরআন পাঠও (ফজরের নামাযও কায়েম কর)। নিশ্চয়ই ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখী হয়।”১৪
এ আয়াতে دلوک শব্দের অর্থ হচ্ছে ঢলে পড়া এখানে সূর্য মধ্যাহ্ন হতে অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়ার সময়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
غسق اللیل শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত্রের অন্ধকারাচ্ছন্ন। কেউ কেউ এ শব্দের ব্যাখ্যায় রাতের প্রথমাংশ আবার কেউ কেউ রাতের মধ্যাংশকে বুঝিয়েছেন। রাগেব ইসফাহানী তার ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, غسق শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের অন্ধকারাছন্ন; যা সাধারণত মধ্যরাতকেই বুঝানো হয়।
সুতরাং دلوک الشمس বা সূর্য ঢলে পড়ার সময়কে যোহর ও আসর নামাযের সূচনালগ্ন,غسق اللیل বা মধ্যরাত্রের সময় হচ্ছে মাগরিব ও এশার নামাযের সামাপ্তি কাল এবং قران الفجر বলতে ফজর নামাযের সময়কে বুঝানো হয়েছে।
যাইহোক পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন ওয়াজিব নামাযের ক্ষেত্রে মাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, না পাঁচটি। আর এ বিষয়টি তিনটি বিশেষ সময় বা ওয়াক্তে নামায সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সুদৃঢ় দলিল হিসেবে প্রমাণিত।
বিশিষ্ট সুন্নী মুফাসসির ফাখরুদ্দীন রাজী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে অত্যন্ত চমকপ্রদ বর্ণনা তুলে ধরেছেন,
أن فسرنا الغسق بظهور أوّل الظلمة-و حکاه عن ابن عبّاس و عطا و النضر بن شمیل-کان الغسق عبارة عن أول المغرب و علی هذا التقدیر یکون المذکور فی الایة ثلاث اوقات وقت الزوال و وقت أوّل المغرب و وقت الفجر، و هذا یقتضی أن یکون الزوال وقتا للظهر و العصر فیکون هذا الوقت مشترکا بین الصلاتین و أن یکون أوّل المغرب وقتا للمغرب و العشاء فیکون هذا الوقت مشترکا أیضا بین هاتین الصلاتین فهذا یقتضی جواز الجمع بیت ظهر و العصر و المغرب و العشاء مطلقا.
গাসাকা (غسق) শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের প্রথমাংশে আধারের আগমণ (ইবনে আব্বাস, আতা এবং নাসর বিন সুমাঈল এ মতের পক্ষে রায় দিয়েছেন)। তাহলে এটা হবে মাগরিবের বা সূর্যাস্তের প্রথম সময়। সুতরাং আয়াতে দৈনন্দিন নামাযের ক্ষেত্রে তিনটি সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যথা: জাওয়াল বা দ্বি-প্রহরের সময়, মাগরিবের প্রথম সময় এবং ফজরের সময়।
অতঃপর তিনি উল্লেখ করেছেন: এটা থেকে বুঝা যায় যে, জাওয়াল হচ্ছে যোহর ও আসর নামাযের সময়; অর্থাৎ এটা এ দু’টি নামাযের জন্য যৌথ সময় হিসেবে গণ্য। আর সূর্যাস্তের প্রথম সময় মাগরিব ও এশার নামাযের যৌথ সময় হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং উক্ত নামাযদ্বয়ের যৌথ সময় রয়েছে। যার ফলাফল হবে যোহর-আসর এবং মাগরিব এশার নামায একত্রে আদায় করা সম্পূর্ণ জায়েয।১৫
যদিও ফাখরুদ্দীন রাজী এ পর্যন্ত উক্ত আয়াতের যথারীতি তাফসীর করেছেন, কিন্তু উপসংহারে এসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু অনিবার্য কোন কারণ ব্যতিত উক্ত নামাযদ্বয় একত্রে পড়া জায়েয নয়, সেহেতু এ আয়াত শুধুমাত্র উক্ত অনিবার্য কারণসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।১৬
আমরা এখানে তার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই যে, অত্র আয়াতে বিশেষ কোন কারণের কথা উল্লেখ করা তো দূরের কথা; বরং খোদ সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থে অনেক রেওয়ায়েতে (যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক সময় কোন বিশেষ কারণ (যেমন: সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা) ছাড়াই যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। যাতে তা মুসলমানদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তারাও যেন এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া উক্ত আয়াতের ঘোষিত তিনটি সময়কে অনিবার্য কিছু কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা মোটেও নিয়মসিদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত নয়।
সুতরাং পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতদ্বয়ে দৈনন্দিন নামাযের জন্য যে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা অস্বীকার করা কোনভাবেই সম্ভব না।
যাইহোক এ অধ্যায়ের আলোচিত বিষয়াবলী হতে আমরা নিম্নের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি :
১-পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন পাঁচটি নামাযের ক্ষেত্রে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২-শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বহুবার বিশেষ কোন কারণ (যেমন: সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা) ছাড়াই দু’টি নামায একত্রে আদায় করেছেন। আর এ সুন্নতকে তিনি তার উম্মতের জন্য বিশেষ সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যাতে তারা কোনরূপ বাড়তি চাপের সম্মুখীন না হয়।
৩-নিঃসন্দেহে দৈনন্দিন পাঁচটি নামায ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু যে কোন মূল্যে এ মুস্তাহাবকে ধরে রাখা এবং রাসূলের (সা.) প্রদত্ত সুযোগকে (দু’টি নামায একত্রে আদায়) এড়িয়ে চলার কারণে অনেক সাধারণ লোক (বিশেষতঃ যুবসমাজ) নামাযের ন্যায় অপরিহার্য ইবাদতের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে এহেন শোচনীয় অবস্থার দায়-দায়িত্ব উক্ত সুযোগ ব্যবহারের বিরোধিদের উপর বর্তাবে।
তাই কোন মুস্তাহাব বিষয়কে ধরে রাখার জন্য ওয়াজিব বিধানের পরিত্যাগ আদৌ সঠিক নয়।
এপ্রিল 11 2024
কেন যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামাজ একসাথে পড়া হয়?
এ প্রবন্ধে আমরা পবিত্র কোরআন, রাসূল (সা.) এবং মাসুম ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েতের আলোকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দু’টি নামায এক সাথে আদায় প্রসঙ্গে তথ্য-সমৃদ্ধ আলাচনা ও পর্যালোচনা করব :
দু’টি নামায এক সাথে আদায় প্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ
সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ও প্রথম শ্রেণীর হাদীস গ্রন্থাবলী যেমন: সহীহ মুসলিম, সহীহ বোখারী, সহীহ তিরমিযী, মুয়াত্তা, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে নাসায়ী এবং মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক প্রভৃতিতে দু’টি নামায একত্রে আদায় তথা যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায অনিবার্য কোন কারণ (যেমন: সফরে থাকা, বৃষ্টি, ভয় কিংবা অনিষ্টের সম্ভাবনা) ছাড়াই একত্রে আদায় সম্পর্কে ত্রিশটির চেয়েও অধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলো মূলত: পাঁচজন প্রথম সারির রা’বীদের থেকে বর্ণিত, যথা:
১-হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)
২-হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.)
৩-হযরত আবু আইয়ুব (রা.)
৪-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এবং
৫-হযরত আবু হুরাইরা।
আমরা সম্মানিত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উক্ত রেওয়ায়েতগুলোর কিয়দাংশ এখানে তুলে ধরছি-
এক- আবুজ্ জুবাইর; সাঈদ ইবনে জুবাইর এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন,
صلّی رسول الله (ص) الظهر و العصر جمیعاً بالمدینة فی غیر خوف و لا سفر.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় অবস্থানকালীন সময়ে কোনরূপ ভীত ও সফরের কারণ ছাড়াই যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করেছেন।”
আবুজ্ জুবাইর বলেন যে, আমি সা’দ বিন জুবাইরের নিকট প্রশ্ন করলাম: কেন রাসূল (সা.) এমনটি করলেন?
জবাবে তিনি বলেন: আমিও অনুরূপ প্রশ্নটি ইবনে আব্বাসের নিকট জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরে তিনি বলেছেন,
أراد أن لا یحرج أحدا من أمّته.
“রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য ছিল যে, তার উম্মতের মধ্যে কেউ যেন বাড়তি চাপের শিকার না হয়।”১
দুই- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে,
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء فی المدینة فی غیر خوف و لا مطر.
“মহানবী (সা.) মদীনাতে কোনরূপ ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছাড়াই যোহর-আসর এবং মাগরিব ও এশার নামায একত্রে আদায় করতেন।”
হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়: এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য কি ছিল?
জবাবে তিনি বলেন: রাসূল (সা.) চেয়েছিলেন যে, কোন মুসলমান যেন নামায আদায়ের ক্ষেত্রে কষ্টের শিকার না হয়।২
তিন- আব্দুল্লাহ বিন শাকিক বলেন,
خطبنا ابن عبّاس یوما بعد العصر حتّی غربت الشمس و بدت النجوم و جعل الناس یقولون الصلاة الصلاة! قال فجائه رجل من بنی تمیم لا یفتر و لا یتنی :الصلاة،الصلاة فقال :ابن عبّاس أتعملنی بالسنّة ،لا أمّ لک ثمّ قال: رأیت رسول الله (ص) جمع بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء قال عبد الله بن شقیق :فحاک فی صدری من ذلک شیء فأتیت اباهریرة فسألته، فصدّق مقالته.
“একদা ইবনে আব্বাস আসরের নামায়ের পর আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় সূর্য অস্তমিত হয় এবং আকাশে নক্ষত্র পরিদৃষ্ট হয়। উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ‘নামায’ ‘নামায’ বলে আওয়াজ তুলেন। অতঃপর বনী তামিম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি সামনে এসে একাধারে ‘নামায’ ‘নামায’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন ইবনে আব্বাস বলেন: হে অজ্ঞ! তুমি কী আমাকে রাসূলের (সা.) সুন্নাতের শিক্ষা দিতে চাও? রাসূল (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক বলেন: আমার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এ কারণে আমি আবু হুরাইরার নিকট এসে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি ইবনে আব্বাসের কথার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।”৩
চার- জাবের ইবনে জায়েদ বলেন: ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে,
صلّی النبی (ص) سبعاً جمیعاً و ثمانیاً جمیعاً.
“রাসূল (সা.) সাত রাকাত (মাগরিব ও এশা’র) নামায একই সময়ে এবং আট রাকাত (যোহর ও আসরে’র) নামায একই সময়ে আদায় করেছেন।”৪
পাঁচ- সাঈদ ইবনে জুবাইর হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন,
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و بین المغرب و العشاء بالمدینة من غیر خوف و لا مطر قال: فقیل لابن عبّاس :ما أراد بذلک؟ قال: أراد أن لا یحرج أمّته.
“মহানবী (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। অথচ তখন কোন ধরনের ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছিল না। ইবনে আব্বাসের নিকট জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) উদ্দেশ্য কি ছিল?
জবাবে তিনি বলেন: তিনি চেয়েছিলেন যে, তার উম্মত যেন কোনরূপ কষ্টের শিকার না হয়।”৫
ছয়- আহমাদ ইবনে হাম্বালও স্বীয় হাদীস গ্রন্থে অনুরূপ একটি হাদীস হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন।৬
সাত- সুন্নী মাযহাবের অন্যতম মনীষী ইমাম মালেক (রহ.) স্বীয় ‘আল মুয়াত্তা’ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাসের (রা.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন,
صلّی رسول الله (ص) الظهر و العصر جمیعا و المغرب و العشاء جمیعا فی غیر خوف و لا سفر.
“রাসূল (সা.) যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। অথচ তখন কোনরূপ ভয় কিংবা বৃষ্টির আশংকা ছিল না।”৭
আট- মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হতে বর্ণিত,
جمع لنا رسول الله (ص) مقیما غیر مسافر بین الظهر و العصر و المغرب فقال رجل لابن عمر: لم تری النبی (ص) فعل ذلک؟ قال لأن لا یحرج أمّته ان جمع رجل.
“মহানবী (সা.) সফর অবস্থাতে না থাকা সত্ত্বেও যোহর ও আসরের নামাযদ্বয় একত্রে আদায় করেন। কেউ ইবনে উমরের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন: কেন রাসূল (সা.) এমনটি করলেন? জবাবে তিনি বলেন: এমনটি করার কারণ হচ্ছে যদি কেউ এ দু’টি নামায একত্রে আদায় করে, তাহলে যেন তার উম্মতের কোন ব্যক্তি কষ্টের সম্মুখীন না হয় (কেউ যেন এক্ষেত্রে আপত্তি না করে)।”৮
নয়- জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত:
جمع رسول الله (ص) بین الظهر و العصر و المغرب و العشاء فی المدینة للرخص من غیر خوف و لا علّة.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনাতে যোহর-আসরের এবং মাগরিব এশার নামায একত্রে আদায় করেন, যাতে তার উম্মত এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। যদিও সেক্ষেত্রে কোন ধরনের সমস্যা কিংবা ভয়-ভীতির আশংকা না থাকে।”৯
দশ- আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত,
جمع رسول الله (ص) بین الصلوتین فی المدینة من غیر خوف.
“রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় কোন ধরনের ভয় কিংবা অনিষ্টের আশংকা (শত্রুদের পক্ষ হতে) না থাকা সত্ত্বেও দু’টি নামায একত্রে আদায় করেছেন।”১০
এগার- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত,
جمع رسول الله (ص) بین الأولی و العصر و المغرب و العشاء فقیل له فقال: صنعته لئلّا تکون أمّتی فی حرج.
“রাসূল (সা.) মদীনায় যোহর-আসরের এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেন। সাহাবীদের মধ্যে একজন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন: আমি এ কাজটি এজন্য করেছি যে, আমার উম্মতের লোকেরা যেন কষ্টের শিকার না হয়।”১১
এখানে দু’টি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যথা:
১- উপরোক্ত হাদীসসমূহের সারাংশ
উপরোক্ত হাদীসসমূহ সুন্নী মাযহাবের সবচেয়ে পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থাবলী হতে উদ্ধৃত। আর এগুলোর সনদও প্রথম শ্রেণীর সাহাবীদের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে দু’টি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; যথা:
প্রথমত: মহানবী (সা.) অনিবার্য কোন কারণ যেমন: সফর, বৃষ্টি এবং শত্রুর ভয়-ভীতির কোন আশংকা ছাড়াই দু’টি নামায (যোহর-আসরের এবং মাগরিব এশার নামায) একত্রে আদায় করেছেন।
দ্বিতীয়ত: তাঁর এ কাজের উদ্দেশ্য ছিল উম্মতের কষ্ট লাঘব এবং প্রশস্ত সুযোগ রাখা। এমতাবস্থায় এটা কী আদৌ সমীচীন যে, এক শ্রেণীর লোকেরা এ ক্ষেত্রে নানাবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করবে এবং এটা প্রচার করবে যে, শুধুমাত্র অনিবার্য কারণবশতঃ দু’টি নামায একত্রে আদায় করা যাবে?
কেন আমরা বাস্তবতা হতে চোখ ফিরিয়ে নিব এবং রাসূলের (সা.) সুস্পষ্ট সুন্নতের পরিপন্থী আকিদার উপর গুরুত্বারোপ করব?
স্বয়ং আল্লাহ ও রাসূল (সা.) যে সুযোগ মানুষকে দিয়েছেন; কেন একশ্রেণীর গোঁড়ামি মানসিকতার ব্যক্তিরা সে সুযোগের যথোচিত ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে?
তারা কেন চায় না মুসলিম যুবকরা সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে, অফিস-আদালতে এবং কল-কারখানায় শরিয়াতের প্রদত্ত সুবিধাজনক পন্থায় প্রতিদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল তথা দৈনন্দিন নামায আদায় করুক?
আমরা বিশ্বাস করি যে, পবিত্র ইসলাম ধর্মেও বিধি-বিধান কিয়ামত অবধি বিশ্বের সর্বত্র ও সর্বকালের জন্য বহাল রয়েছে।
নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) তার নজিরবিহীন দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আজীবন অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর তাই তো তিনি এটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, সবাইকে যদি দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নামায আদায় বাধ্যগত করা হয়, তাহলে একদল মুসলমান নামায পরিত্যাগ করবে (যেমনটি বর্তমানে ঘটেছে)। এ কারণেই তিনি স্বীয় উম্মতের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন এবং মোক্ষম সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যাতে মুসলমানরা যে যেখানেই ব্যস্ত থাকুক না কেন দৈনন্দিন নামাযসমূহ যেন সহজেই আদায় করতে পারে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
“ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখা হয় নি।”১২
২- কোরআন এবং নামাযের তিনটি বিশেষ সময়
আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে পবিত্র কোরআনের দু’টি আয়াতে নামাযের সময় সূচীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে দিবারাত্রের নামাযসমূহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তথাপি সুন্নী মাযহাবের ভাইয়েরা কেন দৈনন্দিন নামাযসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করাকে ওয়াজিব মনে করেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
অবশ্য এ নামাযসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব ও উত্তম হওয়ার বিষয়টি অনস্বীকার্য। আমরাও যদি সময় ও সুযোগ অনুকূলে থাকে তবে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের আপত্তি হচ্ছে এটাকে ওয়াজিব মনে করার ক্ষেত্রে।
নামাযের সময় সূচী সম্পর্কে বর্ণিত প্রথম আয়াতটি সূরা হুদের অন্তর্ভুক্ত এখানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ
“আর নামায আদায় করবে দিনের দুই প্রান্তে এবং রাত্রের প্রান্তভাগে।”১৩
এখানে طرف النهار দিনের দু’প্রান্তে বলতে ফজরের সময় (যে সময়টি হচ্ছে দিনের সূচনালগ্ন) এবং যোহর ও আসরের সময়কে (যা দ্বিপ্রহর থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত) বুঝানো হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, এ আয়াতের মাধ্যমে যোহর ও আসরের নামাযের সময়সীমা সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
পাশাপাশি উক্ত আয়াতে زلفا من اللیل শব্দাবলীর মধ্যে زلف হচ্ছে زلفه এর বহুবচন। বিশিষ্ট আভিধানিক রাগেব ইসফাহানী বলেছেন যে, এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাত্রের প্রথমাংশ; যা মাগরিব ও এশার নামাযের সময়ের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
সুতরাং রাসূল (সা.) বেশির ভাগই দৈনন্দিন পাঁচটি সময়ে নামায আদায় করেছেন এ কারণে যে, তা হচ্ছে মুস্তাহাব ও উত্তম; যে বিষয়টি আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু তাই বলে পবিত্র কোরআনের বাহ্যিক ঘোষণাকে উপেক্ষা করে অন্যরূপ ব্যাখ্যার পেছনে ছোটার কোন প্রয়োজন নেই।
অপর আয়াতটি পবিত্র কোরআনের সূরা বনী ইসরাইল বর্ণিত হয়েছে,
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ
“অপরাহ্ন বা সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম কর এবং ফজরের কোরআন পাঠও (ফজরের নামাযও কায়েম কর)। নিশ্চয়ই ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখী হয়।”১৪
এ আয়াতে دلوک শব্দের অর্থ হচ্ছে ঢলে পড়া এখানে সূর্য মধ্যাহ্ন হতে অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়ার সময়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
غسق اللیل শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত্রের অন্ধকারাচ্ছন্ন। কেউ কেউ এ শব্দের ব্যাখ্যায় রাতের প্রথমাংশ আবার কেউ কেউ রাতের মধ্যাংশকে বুঝিয়েছেন। রাগেব ইসফাহানী তার ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, غسق শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের অন্ধকারাছন্ন; যা সাধারণত মধ্যরাতকেই বুঝানো হয়।
সুতরাং دلوک الشمس বা সূর্য ঢলে পড়ার সময়কে যোহর ও আসর নামাযের সূচনালগ্ন,غسق اللیل বা মধ্যরাত্রের সময় হচ্ছে মাগরিব ও এশার নামাযের সামাপ্তি কাল এবং قران الفجر বলতে ফজর নামাযের সময়কে বুঝানো হয়েছে।
যাইহোক পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন ওয়াজিব নামাযের ক্ষেত্রে মাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, না পাঁচটি। আর এ বিষয়টি তিনটি বিশেষ সময় বা ওয়াক্তে নামায সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সুদৃঢ় দলিল হিসেবে প্রমাণিত।
বিশিষ্ট সুন্নী মুফাসসির ফাখরুদ্দীন রাজী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে অত্যন্ত চমকপ্রদ বর্ণনা তুলে ধরেছেন,
أن فسرنا الغسق بظهور أوّل الظلمة-و حکاه عن ابن عبّاس و عطا و النضر بن شمیل-کان الغسق عبارة عن أول المغرب و علی هذا التقدیر یکون المذکور فی الایة ثلاث اوقات وقت الزوال و وقت أوّل المغرب و وقت الفجر، و هذا یقتضی أن یکون الزوال وقتا للظهر و العصر فیکون هذا الوقت مشترکا بین الصلاتین و أن یکون أوّل المغرب وقتا للمغرب و العشاء فیکون هذا الوقت مشترکا أیضا بین هاتین الصلاتین فهذا یقتضی جواز الجمع بیت ظهر و العصر و المغرب و العشاء مطلقا.
গাসাকা (غسق) শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের প্রথমাংশে আধারের আগমণ (ইবনে আব্বাস, আতা এবং নাসর বিন সুমাঈল এ মতের পক্ষে রায় দিয়েছেন)। তাহলে এটা হবে মাগরিবের বা সূর্যাস্তের প্রথম সময়। সুতরাং আয়াতে দৈনন্দিন নামাযের ক্ষেত্রে তিনটি সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যথা: জাওয়াল বা দ্বি-প্রহরের সময়, মাগরিবের প্রথম সময় এবং ফজরের সময়।
অতঃপর তিনি উল্লেখ করেছেন: এটা থেকে বুঝা যায় যে, জাওয়াল হচ্ছে যোহর ও আসর নামাযের সময়; অর্থাৎ এটা এ দু’টি নামাযের জন্য যৌথ সময় হিসেবে গণ্য। আর সূর্যাস্তের প্রথম সময় মাগরিব ও এশার নামাযের যৌথ সময় হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং উক্ত নামাযদ্বয়ের যৌথ সময় রয়েছে। যার ফলাফল হবে যোহর-আসর এবং মাগরিব এশার নামায একত্রে আদায় করা সম্পূর্ণ জায়েয।১৫
যদিও ফাখরুদ্দীন রাজী এ পর্যন্ত উক্ত আয়াতের যথারীতি তাফসীর করেছেন, কিন্তু উপসংহারে এসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু অনিবার্য কোন কারণ ব্যতিত উক্ত নামাযদ্বয় একত্রে পড়া জায়েয নয়, সেহেতু এ আয়াত শুধুমাত্র উক্ত অনিবার্য কারণসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।১৬
আমরা এখানে তার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই যে, অত্র আয়াতে বিশেষ কোন কারণের কথা উল্লেখ করা তো দূরের কথা; বরং খোদ সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থে অনেক রেওয়ায়েতে (যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক সময় কোন বিশেষ কারণ (যেমন: সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা) ছাড়াই যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামায একত্রে আদায় করেছেন। যাতে তা মুসলমানদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তারাও যেন এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া উক্ত আয়াতের ঘোষিত তিনটি সময়কে অনিবার্য কিছু কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা মোটেও নিয়মসিদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত নয়।
সুতরাং পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতদ্বয়ে দৈনন্দিন নামাযের জন্য যে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা অস্বীকার করা কোনভাবেই সম্ভব না।
যাইহোক এ অধ্যায়ের আলোচিত বিষয়াবলী হতে আমরা নিম্নের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি :
১-পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন পাঁচটি নামাযের ক্ষেত্রে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২-শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বহুবার বিশেষ কোন কারণ (যেমন: সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা) ছাড়াই দু’টি নামায একত্রে আদায় করেছেন। আর এ সুন্নতকে তিনি তার উম্মতের জন্য বিশেষ সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যাতে তারা কোনরূপ বাড়তি চাপের সম্মুখীন না হয়।
৩-নিঃসন্দেহে দৈনন্দিন পাঁচটি নামায ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু যে কোন মূল্যে এ মুস্তাহাবকে ধরে রাখা এবং রাসূলের (সা.) প্রদত্ত সুযোগকে (দু’টি নামায একত্রে আদায়) এড়িয়ে চলার কারণে অনেক সাধারণ লোক (বিশেষতঃ যুবসমাজ) নামাযের ন্যায় অপরিহার্য ইবাদতের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে এহেন শোচনীয় অবস্থার দায়-দায়িত্ব উক্ত সুযোগ ব্যবহারের বিরোধিদের উপর বর্তাবে।
তাই কোন মুস্তাহাব বিষয়কে ধরে রাখার জন্য ওয়াজিব বিধানের পরিত্যাগ আদৌ সঠিক নয়।
মূলঃ আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি
অনুবাদ : মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান
তথ্যসূত্র:
১। সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫১।
২। প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২।
৩। প্রাগুক্ত।
৪। সহীহ বোখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪০।
৫। সুনানে তিরমিযী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২১, হাদীস নং ১৮৭।
৬। মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ.২২৩।
৭। আল মুয়াত্তা, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৪।
৮। মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫৬।
৯। মায়ানিউল আসার, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬১।
১০। মুসনাদে আল বাজ্জায, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৩।
১১। আল মো’জামুল কাবীর, তাবরানী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৯, হাদীস নং ১০৫২৫।
১২। সূরা হজ্ব : ৭৮।
১৩। সূরা হুদ:১১৪।
১৪। সূরা বনী ইসরাইল : ৭৮।
১৫। তাফসীরে কাবীর, ২১তম খণ্ড, পৃ. ২৭।
১৬। প্রাগুক্ত।
(সূত্র: আল বাসাইর)
By bn • মুস্তাবসেরগণের মুনাজিরা 0