পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মসজিদ

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মসজিদ
পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মসজিদ

বাঙালি মুসলমান, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্প্রদায়; যারা বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। নবাব মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশা বা অখণ্ড বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। এভাবেই বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা।

২০২১ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের তিন কোটি ১১ লাখ ৪৪ হাজার মুসলমানের মধ্যে ২.৪ কোটিই বাঙালি মুসলমান।

মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুর—এ তিন জেলায় বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রদেশের অন্তত ১০টি জেলায় মুসলমানদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
ইমামস অ্যাসোসিয়েশন ও ওয়াকফ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে কমপক্ষে ৫০ হাজার মসজিদ আছে। পশ্চিম-দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর থানার পিরপালে আছে বখতিয়ার খলজির কথিত সমাধি! মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরের খোশবাগে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তাঁর স্ত্রী বেগম লুত্ফুন্নেসা, নবাব আলীবর্দী খাঁ ও অন্যদের সমাধি অবস্থিত।

এ ছাড়া আছে উপমহাদেশের বৃহত্তম আদিনা মসজিদ, মেদিনীপুরের বিখ্যাত চন্দ্রকোনা জোড়া মসজিদ, ওয়াজেদ আলীর মসজিদ, জাহানিয়া মসজিদ, বশরী শাহ মসজিদ, হুগলি ও মুর্শিদাবাদ ইমামবাড়া, বাঁকুড়া গড় দরওয়াজা, কাঠগোলা, নসিপুর প্রাসাদ ইত্যাদি।

পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান :

১. কাটরা মসজিদ

কাটরা মসজিদ মুর্শিদাবাদ রেলস্টেশনের এক হাজার ৬০০ মিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। পাঁচ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির পরিমাপ ৩৯.৬২–৭.৩২ মিটার। মসজিদটির চার কোণে আছে চারটি বরুজ এবং বরুজগুলো সরু হয়ে ওপরে উঠে গেছে; প্যাঁচানো সিঁড়িপথ বরুজের ওপর পর্যন্ত প্রলম্বিত। মসজিদটি চতুর্দিক দ্বিতল কক্ষ সারি দ্বারা পরিবেষ্টিত, কক্ষগুলো মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ তাঁর নতুন রাজধানীর নাম দেন মুর্শিদাবাদ। কাটরা মসজিদটি নতুন রাজধানীর জামে মসজিদ। মসজিদ প্রাঙ্গণেই মুর্শিদকুলী খাঁর সমাধি আছে।
২. নাখোদা মসজিদ

এটি কলকাতার অন্যতম মসজিদ। মসজিদটি মধ্য কলকাতার পোস্তা, বড় বাজার এলাকার জাকারিয়া স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে অবস্থিত।

নাখোদা শব্দের অর্থ নাবিক। বিশিষ্ট নাবিক আবদুর রহিম ওসমান আগ্রার সিকান্দ্রায় অবস্থিত মোগল সম্রাট আকবরের সমাধি সৌধের অনুকরণে ১৯২৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
কদম রসুল মসজিদ
এই মসজিদ মালদহ জেলার গৌড়ে অবস্থিত। চতুষ্কোণ এক গম্বুজ মসজিদটি ১৫৩০-১৫৩১ সালে সুলতান নসরত শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়। কদম রসুল একটি পবিত্র স্থান, যেখানে নবী (সা.)-এর পদচিহ্ন সংবলিত পাথর খণ্ড সংরক্ষিত আছে। জনশ্রুতি মতে, ১৩ শতকের সাধক জালালউদ্দিন তাবরিজি (রহ.)-এর পাণ্ডুয়ায় ইবাদতখানায় এই পদচিহ্ন সংবলিত পাথরটি পাওয়া যায়। নুসরত শাহের পিতা সুলতান হোসেন শাহ এ পাথর গৌড়ে নিয়ে আসেন। গৌড়ে বর্তমানে কদম রসুল মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট এবং গম্বুজে রয়েছে প্যাঁচানো নকশা। মসজিদের চার কোণে আছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির কর্নার টাওয়ার। মসজিদের পূর্ব দিকের দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশদ্বার। কিবলা দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব এবং মধ্যের মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড়।

৩. টিপু সুলতান মসজিদ

এটি কলকাতার একটি বিখ্যাত মসজিদ। ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ।

৪. ফুটি মসজিদ

ফুটি মসজিদ বা ফৌত মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন মসজিদ। এই মসজিদের নির্মাতা মুর্শিদকুলী খাঁর দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খান। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও উচ্চতা যথাক্রমে ১৩৫–৪০ ফুট। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার আছে। এ মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদের মিল আছে। কথিত আছে, নবাব সরফরাজ খান এক রাতের মধ্যেই বিশাল এই মসজিদ বানানোর চেষ্টা করেন। তিনি কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। কারণ নবাব আলীবর্দী খাঁর নেতৃত্বাধীন ফৌজের হাতে নবাব সরফরাজ খান নিহত হন। তাই অসম্পূর্ণ গম্বুজের কারণে মসজিদটি ফৌতি মসজিদ বা ফুটি মসজিদ বলে পরিচিত হয়।

বস্তুত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষাগত সংহতি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুনিবিড়। এ জন্যই কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি সীমান্তে আছে একটি মসজিদ; প্রায় ২০০ বছর ধরে এ মসজিদে নামাজ আদায় করছেন দুই বাংলার মানুষ। কবির ভাষায়:

‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ

কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,

সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ…।’

তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা : বাংলাপিডিয়াসহ ইন্টানেটের বিভিন্ন সাইট।